বড় শিরোপা না জিতলেও বাংলাদেশ দল বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সাফল্য অবশ্য পেয়েছে। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়, ২০১৭ সালে টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার মাঠে টেস্ট সিরিজ ড্র; ২০১২, ২০১৬, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা।
ইসমাঈল গাজী সৌরভ, ঢাকা:
গত এক দশকে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হলেও বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অর্থনৈতিক অবস্থান যতটা শক্তিশালী হয়েছে, ব্যাটে-বলে সাফল্যের হার ততটা বাড়েনি।
বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এসিসির সাবেক প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আশরাফুল হক দুঃখের সাথে জানালেন তার অভিমত।
তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের মতন দেশের কাছে আমরা হারি। ২০ (২১) বছর হয়ে গেল, এখনো টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে আমরা নয়-দশে আছি’।
শুধু সৈয়দ আশরাফই নন বরং দেশের সব ক্রিকেটপ্রেমীরই এখন এই এক আফসোস।
আকাশ-পাতাল পার্থক্য টাকা ও মাঠের পারফরম্যান্সে
গত ১০ বছরে বিসিবির জমা তহবিল বা স্থিতি বেড়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ফিক্সড ডিপোজিটে (এফডিআর) বিনিয়োগ করে মাত্র তিনটি অর্থবছরে বিসিবি সুদ থেকেই ১৫২ কোটি টাকা আয় করেছে। শুধু গত অর্থবছরেই বিসিবির এফডিআর করা ছিল ৫৪৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের মতন মধ্যম আয়ের দেশের হিসেবে একটি ক্রীড়া সংস্থার তহবিল বিশাল হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্রিকেটারদের সাফল্য তুলনামূলক কমই। শীর্ষ তিন ধনী ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই (ভারত), ইসিবি (ইংল্যান্ড), সিএ (অস্ট্রেলিয়া)-এর পরে সম্পদের দিক থেকে যে বিসিবি’র অবস্থান মাঠের সাফল্য বিবেচনায় পিছিয়েই আছে টিম টাইগার্স।
২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরে প্রায় ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় থাকার পরও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) ক্যাবিনেটে গত দশ বছরে শিরোপা উঠেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিরও। ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে তারা। জিতেছে ২০১২ এশিয়া কাপও।
আর্থিকভাবে ক্রমেই দুর্বল হতে থাকা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের (এসএলসি) গত এক দশকে অর্জন ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১৪ এশিয়া কাপের ট্রফি। শ্রীলঙ্কা খেলেছে ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালেও। আর্থিকভাবে বিসিবির চেয়ে স্পষ্ট দূরত্বে থাকা নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও (এনজেডসি) কদিন আগে ভারতকে হারিয়ে জিতে নিয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি।
যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডকে (ডব্লউআইসিবি) সিরিজ আয়োজন করতে বিসিবির কাছে সাহায্য চাইতে হয়, তারা টানা দুটি টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে (২০১২, ২০১৬)।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা এসেছে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, সেটিও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কাছে। এর আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নারী দলের এশিয়া কাপ জয়টাই ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিসিবির সবচেয়ে বড় সাফল্য।
কিন্তু, যে দলটিকে কেন্দ্র করে বিসিবির এত আয় আর যে দলে গত এক দশকে সমৃদ্ধ হয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজুর রহমানের মতো বড় বড় তারকা খেলোয়াড়দের উপস্থিতিতে; সেই দলের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৯ সালের মে মাসের আয়ারল্যান্ড সফরের ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়।
আর্থিক শক্তি বাড়ার সাথে সাথে সমানতালে বাড়েনি যে মাঠের সাফল্য সেটা নিজেই স্বীকার করলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ।
‘শ্রীলঙ্কা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন নই…।’ তবে তিনি টাকার সঙ্গে সাফল্য মেলাতে চাননি। নিজাম উদ্দিন বললেন, ‘টাকার সঙ্গে (মাঠের) সাফল্যের কোনো তুলনা হয় না। এটা তো এমন নয় যে, ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন পেলেন। শেয়ার মার্কেটও এটা নয়। এখানে একটু সময় দিতে হবে। আমরা হয়তো একটু বেশি সময় নিচ্ছি—এটি বলতে পারেন।’
বড় শিরোপা না জিতলেও বাংলাদেশ দল বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সাফল্য অবশ্য পেয়েছে। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়, ২০১৭ সালে টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার মাঠে টেস্ট সিরিজ ড্র; ২০১২, ২০১৬, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা।
২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইট, ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল আর ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে উঠেছিল বৈশ্বিক প্রতিযোগীতায়। আর দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে ভারত-পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন ওয়ানডে সিরিজ জয় বড় অঙ্কের স্পন্সরশিপ মানি পেতে বিসিবিকে সহায়তা করেছে ।
শিরোপা জয়েই নয়, আইসিসির তিন সংস্করণের র্যাঙ্কিংয়েও বাংলাদেশ দলের বড় কোনো অগ্রগতি নেই। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে ওঠাই বাংলাদেশের বড় সাফল্য। টেস্ট, টি-টোয়েন্টিতে এখনো নয়-দশ নম্বরেই আটকে আছে বাংলাদেশ।
উন্নয়নে যেভাবে টাকার ব্যবহার
ক্রিকেটের উন্নয়নের চিত্রটা কেমন হওয়া দরকার সেটি খোলামেলাই ব্যাখ্যা করলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ।
তার মতে, আমরা একটা দিকে (আর্থিক) উন্নতি করেছি, এখন আরেকটি দিকে (মাঠের পারফরম্যান্স) উন্নতি করতে হবে। আমরা কৃচ্ছ্রসাধন করছি, তা নয়। প্রচুর ব্যয় করছি। ফল আসতে সময় লাগবে। পাঁচ-সাত বছর আগে আইসিসিতে বলেছিলাম, আমরা বেশি করে খেলতে চাই। এখন আমরা অনেক ম্যাচ পাচ্ছি। উন্নতি করতে হলে আপনাকে প্রচুর খেলতে হবে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলছি। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জিতলাম, আয়ারল্যান্ডে ট্রফি জিতলাম—এগুলো উন্নয়নে প্রভাব ফেলে না। আমাদের উন্নয়ন তখন বোঝাবে, যখন অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ম্যাচ জিতব, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে জিতব।
বিপুল টাকা থাকার পরও বিসিবির সাফল্য কেন কম, এ প্রশ্নে যে উত্তরটা মিলছে—মিরপুরের বাইরে খেলোয়াড় তৈরির ‘কারখানা’য় ক্রিকেট বোর্ডের বিনিয়োগ তুলনামূলক কম। বিসিবি খুব একটা ব্যয় করে না জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক ক্রিকেট উন্নয়নে। যদিও গেম ডেভেলপমেন্টে বেশ বড় অঙ্কই বরাদ্দ রাখে বিসিবি।
চলতি অর্থবছরেও তাদের বরাদ্দ আছে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্রিকেট উন্নয়নে ব্যয় করেছিল ২২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে ২৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। গত এক দশকে বিসিবি ক্রিকেট উন্নয়নে গড়ে প্রতি অর্থবছরে ১৬-১৭ কোটি টাকা খরচ করেছে। যদিও লজিস্টিক অ্যান্ড প্রটোকলেই এর দ্বিগুণ খরচ করে বিসিবি।
‘আমাদের কোচ, আম্পায়ারিং এমনকি মাঠকর্মীদের উন্নয়নে যদি পরিকল্পিতভাবে খরচ করা হতো, গত ১৫ বছরে আমাদের দেশের ক্রিকেট অনেক উন্নত হয়ে যেত। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ক্রিকেট উন্নত করা দরকার। প্রান্তিক পর্যায়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার।’- অভিমত সৈয়দ আশরাফের।