More

    হঠাৎ ঘোষণায় স্বাধীনতা আসে না- প্রধানমন্ত্রী

    নিজস্ব প্রতিবেদক:

    হঠাৎ ঘোষণায় স্বাধীনতা আসে না, সেটা আসেনি। সংগ্রামের পথ বেয়ে স্বাধীনতা এসেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আর সেটা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তারই অবদানে আমাদের স্বাধীন সত্ত্বা, স্বাধীন জাতিসত্ত্বা এবং বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

    রোববার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশ পদক ২০২২ প্রদান অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

    প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ আমাদের প্রেরণা দেয়, একুশ মানে মাথা নোয়াবার নয়। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন দেশ। আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় পেয়েছি। পাকিস্তান নামে যে দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল, তার কয়েক মাস পরে প্রথম আঘাত আসে বাঙালির সংস্কৃতির উপর। মাতৃভাষায় কথা বলা যাবে না। বিজাতীয় উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে এ ধরনের এলান জারি করেছিল পাকিস্তানি শাসক দল। তারই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই বাঙালি জাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম উদ্যোগ নেন, তা ছাড়া আমাদের অনেক সুধীজন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিন্তু ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সেদিন গ্রেপ্তারও হন। এরপর ১৫ মার্চ মুক্তি পান। ১৬ মার্চ আমতলায় একটি সভা হয়, সেই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন।

    তিনি বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা হয়। এটা করতে গিয়ে তিনি শুধু ঢাকায় না, ফরিদপুরেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় বারবার তিনি গ্রেপ্তার হন, মুক্তি পান আবার আন্দোলন করেন। এই সংগ্রামের পথ বেয়েই আমরা এগিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘৪৯ সালের ডিসেম্বরে যখন বন্দি করা হলো, তখন আর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ‘৫২ সালে প্রাদেশিক পরিষদের আইন সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব যেন উত্থাপন করা যায় সে জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসেছিলেন। মেডিকেল কলেজের কেবিনে গোপনে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে গভীর রাতে দেখা করেন। সেটা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে স্পষ্ট লেখা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তখনকার গোয়েন্দা বিভাগের যে রিপোর্ট, আমি ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছি; সেই বইতেও এ কথা দেওয়া আছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ আছে, তিনি গোপনে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।

    সেখানে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ জানানো হবে এবং ভাষার জন্য আন্দোলন করতে হবে। ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই যেন সংগ্রাম পরিষদটা গড়ে উঠে। আবার সেই সংগ্রাম পরিষদ গড়া হয়। কাজী গোলাম মাহাবুবসহ আরও অনেকেই ছিলেন। সেই প্রতিবাদ সভায় গুলি হয়, যেখানে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেক সংগ্রামী বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্তের অক্ষরে লিখে দিয়ে যায়, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

    তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের রক্ত দানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা যে বাঙালি, আমাদের যে একটা জাতিসত্ত্বা আছে, আমাদের সংস্কৃতি আছে, আমাদের ভাষা আছে, সেটাই তিনি (বঙ্গবন্ধু) প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। সেভাবে তিনি একটি রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। যে রাষ্ট্র হবে শুধুমাত্র বাঙালিদের রাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্র, আমরা সেখানে স্বাধীনভাবে আমাদের সংস্কৃতির চর্চা করতে পারবো। আমাদের ভাষা সাহিত্য বিকশিত হবে এবং আমরা একটি জাতিস্বত্বা হিসেবে বিশ্ব দরবারে আত্মমর্যাদা পাব।

    পাকিস্তানি শাসকদের লক্ষ্য ছিল জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস করে দেওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেবলমাত্র ধর্মের অজুহাত দিয়ে ১২ শ মাইল দূরত্ব নিয়ে দুটি খন্ড এক করার চেষ্টা এবং দুটি জাতির মধ্যে যেখানে ভাষা থেকে শুরু করে সব কিছুতে বিরাট ব্যবধান, সেখানে এক রাখার প্রচেষ্টা তারা চালিয়েছিল। সে জন্য তারা আমাদের ভাষার ওপর সবার আগে আঘাতটা হানে। আমরা সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তা অতিক্রম করে আজ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতায় বিভিন্ন জন যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা তো বটেই, তার বাইরে যারা ভেতরে ছিলেন প্রত্যেকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। প্রতিটি সংগ্রামে অবদান রয়েছে মানুষের। কেউ সরাসরি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন, পাশাপাশি সংস্কৃতির মাধ্যমে গান, নাটিকা, কবিতা বিভিন্নভাবে এই সংগ্রামে সহযোগিতা করেছেন। তাদের অবদান সব সময় চির স্মরণীয়। আজকে যে কজন গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন তাদের অনেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ‘৬৯ এর গণঅভ্যত্থান থেকে শুরু করে ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মুক্তির সংগ্রামে তাদের অবদান রয়ে গেছে। তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের সম্মানিত করা সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের নতুন প্রজন্ম তাদের পরিচয় করে দেওয়া যে, সবার কত অবদান ছিল, কত ত্যাগ ছিল- যার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। হঠাৎ ঘোষণায় স্বাধীনতা আসে না, সেটা আসেনি। সেই সংগ্রামের পথ বেয়ে স্বাধীনতা এসেছে। আর সেটা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তারই অবদান আমাদের স্বাধীন সত্ত্বা, স্বাধীন জাতিসত্ত্বা এবং বাংলাদেশ একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

    শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যখন দেশকে গড়ে তুললেন এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন উন্নয়নের পথে। তখনই আমাদের ওপর আবার আঘাত এলো। মনে হলো, ১৯৭১ সালে যাদের আমরা পরাজিত করেছিলাম, ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম, সেই বিজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট। জাতির পিতাকে হত্যার পর এ দেশের আদর্শ-নীতি সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। বাংলাদেশে সব ধর্ম-বর্ণে মানুষ তার অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষায়-দীক্ষায় অর্থনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, সার্বিকভাবে সাফল্য অর্জন করবে। বিশ্ব দরবারে বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলবে, এটা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্খা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ৭৫ এর পর সেই চেতনা থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা পিছিয়ে পড়ি।

    তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা, ৫৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখনই প্রথম এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ঘোষণা করা হয়। এমনকি শহীদ মিনার নির্মাণ করার যে প্রকল্প এবং সেখানে বাজেট বরাদ্দ সেটাও করা হয়েছিল। ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখানো সেটাও সেই ৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই করেছিল। স্বাধীনতার পর পুনরায় আমরা যখন সরকারে আসি, আমাদের প্রচেষ্টা ছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের না যারা মাতৃভাষা ভালোবাসে-মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছে এবং মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করা, হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা খুঁজে বের করা এবং সেগুলো সংরক্ষিত করা সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টায় আমরা সফলকাম হয়েছি। আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশে না, বিশ্বব্যাপী এটা পালন করা হচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি।

    স্বাধীনতাকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যেতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। বিশ্বে ৭৫-এর পর বাংলাদেশকে অনেক হেয় করে দেখা হতো। অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি আজকের বাংলাদেশ সারা বিশ্বে একটা আলাদা মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যেটা হয়তো আমরা অনেক আগে করতে পারতাম। যদি আমাদের অর্থাৎ বাঙালির জীবনে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট না ঘটতো। যদি জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো।

    সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জানি সবাইকে আমরা দিতে পারি না। তবু আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে যারা এক সময় অবদান রেখেছেন, আবার অনেকে হারিয়েও যাচ্ছেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের খুঁজে বের করতে এবং তাদের সম্মান করতে। যাতে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে আমাদের দেশের মানুষ মুক্তি পায়। ৭৫ এর পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে অবদান সেটা তো মুছেই ফেলা হয়েছিল। আসলে সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ইতিহাস ঠিকই ফিরে আসে। আজকে আমাদের সেই দিন।

    এর আগে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী একুশে পদক তুলে দেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে চলতি বছরের একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্টজনদের নাম প্রকাশ করা হয়।

    ২০২২ সালের একুশে পদক দেওয়ার জন্য মনোনীত ব্যক্তিরা হলেন- ভাষা আন্দোলনে মোস্তফা এম এ মতিন (মরণোত্তর) ও মির্জা তোফাজ্জল হোসেন (মুকুল) (মরণোত্তর); শিল্পকলা (নৃত্য) বিভাগে জিনাত বরকতউল্লাহ, শিল্পকলা (সংগীত) বিভাগে নজরুল ইসলাম বাবু (মরণোত্তর), ইকবাল আহমেদ ও মাহমুদুর রহমান বেণু; অভিনয়ে খালেদ মাহমুদ খান (মরণোত্তর), আফজাল হোসেন ও মাসুম আজিজ; মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মো. মতিউর রহমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (মরণোত্তর), কিউ এ বি এম রহমান ও আমজাদ আলী খন্দকার; সাংবাদিকতায় এম এ মালেক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মো. আনোয়ার হোসেন; শিক্ষায় অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ; সমাজসেবায় এস এম অব্রাহাম লিংকন ও সংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথের; ভাষা ও সাহিত্যে কবি কামাল চৌধুরী ও ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ; গবেষণায় ড. মো. আবদুস সাত্তার মন্ডল, ড. মো. এনামুল হক, ড. সাহানাজ সুলতানা ও ড. জান্নাতুল ফেরদৌস।

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img