খুলনা প্রতিনিধি:
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিকারি চক্রের সদস্যরা। একের পর এক নিধন করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী। বনদস্যু ও জলদস্যু দমন হলেও সুন্দরবনে চোরা শিকারিচক্র দমন করা যায়নি। খুলনার কয়রায় সুন্দরবনে হরিণ শিকার হঠাৎ করেই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ২০ শিকারিকে হরিণের মাংস ও চামড়াসহ আটক করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না। স্থানীয়রা বলছে, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধি।
তারা শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিনকে দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে। অভিযোগ আছে, কিছু মাছ কোম্পানি ও চোরা শিকারীদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। বরং মানুষ সচেতন হওয়ায় এবং পুরস্কারের আশায় শিকার হওয়ার প্রাণী ও শিকারি ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এ কারণেই শিকার বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাস থেকে মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে শিকার করা ২টি হরিণের মাথা, ১টি গুইসাপ, ৪টি হরিণের চামড়া, ১২০ কেজি মাংস, ১৮০টি হরিণ মারার ফাঁদ জব্দ করা হয়। আটক করা হয় ২০ জন চোরা শিকারিকে। বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা এ বন্যপ্রাণীর অংশ বিশেষসহ শিকারিদের আটক করে।
জানুয়ারি থেকে মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত বন্যপ্রাণী আইনে কয়রায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি মামলা হরিণ শিকার চোরাকারবারির বিরুদ্ধে। যা বর্তমানে চলমান আছে। জানা গেছে, সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে কেওড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কখনও তারা গুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে দেয়। প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করছে বলে জানা যায়৷
সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বানিয়াখালি, নোয়ানি, হড্ডা, খোড়লকাটি, তেতুলতলার চর, জোড়শিং, ছোট আংটিহারা, গোলখালি, ৫নং কয়রা, পবনা, ৪নং কয়রা এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পেশাদার হরিণ শিকারিদের বিশেষ সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করে কিছু বিগত দিনের বনদস্যুদের পৃষ্টপোষক নামধারী মাছ কোম্পানী (এজেন্ট ব্যবসায়ীরা)। এসব এজেন্টের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম অর্ডারে, আবার কখনও তাৎক্ষণিকভাবে মাংস এনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হচ্ছে। এ হরিণের মাংস উপজেলা সদর, খুলনা-সাতক্ষীরা এমনকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে নানা দামে। তবে বেশি দামে বিক্রি হয় চামড়া।
উপজেলার জোড়শিং গ্রামের বাসিন্দা আহাদুজ্জামান জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবে হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শিকারিদের বন বিভাগের লোকজন চেনে। কিন্তু তাদের কখনও গ্রেফতার করে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়রা উপজেলার তেতুলতলার চর গ্রামের জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। লোভে পড়ে হরিণের মাংস বহন করতে গিয়ে ধরা পরেছি, জেল খেটেছি, জরিমানা দিয়েছি। কিন্তু হরিণ শিকার তো থামেনি, আমাদের জায়গায় এসেছে নতুন মানুষ, রাঘব বোয়ালরা রয়ে গেছে অগোচরে। যারা আমাদের মতো অসহায়দের অর্থের লোভ দিয়ে ব্যবহার করে, আপনারা তাদের ধরুন।
কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএমএস দোহা (বিপিএম) বলেন, ‘হরিণ শিকার ও পাচার রোধে আমরা সবসময় সতর্ক রয়েছি। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংসসহ পাচারকারীদের গ্রেফতার করছি। তবে আগের তুলনায় হরিণ শিকার অনেকটাই কমে এসেছে। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্সে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। হরিণ শিকারের মূল হোতাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতা ও লোকবল সংকটের মধ্যেও হরিণ শিকারিদের অপতৎপরতা রোধ করতে বন বিভাগ সবসময় তৎপর। বনরক্ষীদের পাশাপাশি আমাদের স্মার্ট পেট্রোল দল সবসময় কাজ করছে। যাদের আমরা আটক করে আদালতে প্রেরণ করি তারা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা গেলে এ জাতীয় অপরাধ সংঘটনের হার বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এছাড়া আমরা বিভিন্নভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সচেতনতামূলক কর্মকান্ড গ্রহণ করেছি।’