নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠানটির গ্রেফতার ৮ কর্মকর্তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে পুলিশ।
সজিব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডসের ভবনে ৫২ জনের প্রাণহানির ঘটনায় হওয়া মামলা তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ।
জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফাহমিদা খাতুন শনিবার বিকেলে তাদের রিমান্ড আবেদন গ্রহণ করে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম’কে তার চার ছেলে সহ কোম্পানি’র সর্বমোট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যম’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতার আটজনের মধ্যে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমের চার ছেলে সজীব গ্রুপের গ্রুপের ডিএমডি হাসিব বিন হাসেম ওরফে সজীব, (পরিচালক) তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম।
অপর চারজন হলেন- প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেনশাহ আজাদ, হাসেম ফুডসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন।
এর আগে পুলিশ আটজনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
কারখানাটি পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সারাদেশের মানুষ এ ঘটনায় স্তব্ধ। এত মানুষের প্রাণহানি খুবই দুঃখজনক। প্রথমে তিনজন, পরে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। ফায়ার সার্ভিস কিছু জীবিতকেও উদ্ধার করেছে।’
এখন পর্যন্ত আটজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কারখানায় কত শ্রমিক ছিল সবই তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
কারখানায় শিশুশ্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিশুশ্রমিকদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিঁড়িতে ও ছাদে তালা দেয়া ছিল কি-না তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলেন, ‘৩০২ ধারায় আটজনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেছে পুলিশ। সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, তার চার ছেলে সহ আটজন গ্রেফতার হয়েছেন।’
কারখানার ভিতরে আটকা পড়া শ্রমিকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
কারখানার ভিতরে আটকা পড়া শ্রমিক ফাতেমা তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছে।
ফাতেমা বলেন, ‘আমরা তিনতলায় আমগো দুই জন মেয়ে দিছে বোতল লিক করতাছি, আগুন লাগছে। কোন সেকশনে জানাজানি হয় নাই। তখন আমার সাথেরজন দেখে আগুন লাগছে।
‘কোনো কিছু দেয় না, একটা দড়ি বা মইও দেয় না, নামব মানুষ। তখন অনেকে লাফ দিছে, লাফ দিয়া মইরা গেছে।
‘তখন আমি বললাম যে, মরলে নিচে গিয়া মরব। ওপরে তো নিঃশ্বাস দিতে পারতেছি না। তখন আমি লাফ দিছি, ওপর পইরা অনেক ব্যাথা পাইছি। আমার সাথে যে, হে ১০ মিনিট পর লাফ দিয়েছে’।
আরেক শ্রমিক রহিমা বলেন, ‘আগুন লাগার পরে সব শ্রমিক জানালার কাছে চলে আসে। জানালার কাছে দাঁড়াইয়া নিঃশ্বাস নিতেছিল। ছোট বাচ্চাগুলান জানালার বাইরে হাত বাড়াইয়া তাদের নামাইয়া আনতে কইতেছিল।’
ভবনটির ছাদে ওঠার সিঁড়ি বন্ধ ছিল
পরিদর্শন শেষে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে ভবনটির ছাদে ওঠার সিঁড়ি নেট দিয়ে বন্ধ ছিল। নেট থাকায় শ্রমিকরা ছাদে উঠতে না পারার কারণে আগুনে মৃত্যু বেড়েছে।’
আরও বলেন, ‘এখানের নথিপত্র খতিয়ে দেখা হবে। আমাদের অধিদপ্তর থেকেই তদন্ত করা হবে।’
কলকারখানা অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রধান উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন, ‘আমাদের দপ্তর থেকে ডিআইজি সেফটিকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি হয়েছে। কমিটি এরই মধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে।’
পরিদর্শন শেষে র্যাব প্রধান আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, ‘এই অগ্নিকাণ্ড যাদের অবহেলায় হয়েছে, জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’।
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর আলাদা তদন্ত কমিটি করেছে। তারা তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিলে দোষীদের চিহিৃত করা সম্ভব হবে’।
উদ্ধারকাজে র্যাব সার্বিক সহায়তা করছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির মহাপরিচালক।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ‘ভবনের চারতলা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে । পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় এখনও উদ্ধারকাজ শুরু হয়নি। পুরো ভবনের উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হলে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা বের হবে।’
সিঁড়ির গেটে তালা আগুন লাগার পরে লাগানো হয়
কারখানার ভেতরে কোনো সমস্যা হলেই সিঁড়ির গেটগুলোতে তালা দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন কর্মীরা। গতকালও আগুন লাগার পর গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। একথা ভেতরে আটকে থাকা শ্রমিকরা ফোনে বাইরে থাকা স্বজনদের জানিয়েছেন।
ভবনের চতুর্থ তলায় কাজ করতেন আছমা। আছমা বলেন, ‘আগুন লাগার পর চারতলায় সিঁড়ির গেটে তালা দিয়ে দিলে লোকজন উপরে যাইতে পারেনি’।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস।’
কোন ফ্লোরে কী প্রতিষ্ঠান
ছয়তলার পুরো ভবনটিতেই সজীব গ্রুপের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বিপনন উপযোগী করা হতো।
কারখানার শ্রমিকদের তথ্যমতে, নিচতলায় বিভিন্ন পণ্যের কার্টন আর অন্যপাশে ছিল নুডলস ও মেকারনি তৈরির সেকশন। দ্বিতীয় তলায় টোস্ট-বিস্কুট, তৃতীয় তলায় ছিল লাচ্ছা সেমাই-জুস তৈরির মেশিন। চতুর্থ তলায় কয়েকটি খাদ্যপণ্য তৈরির মেশিন। পঞ্চম তলায় চানাচুর, ষষ্ঠ তলায় গুদাম ছিল।