সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
দীর্ঘদিন কার্যত চিকিৎসকশূন্য অবস্থায় চলছে জেলার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান আশ্রয়স্থল সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল। সার্জারি, গাইনি, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, পেডিয়েটিক, ইএনটি, প্যাথলজি ও রেডিওলজিস্টসহ ১৬ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে। ২১ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে মাত্র পাঁচজন ডাক্তার দিয়েই চলছে ১০০ বেডের এ হাসপাতালটি। জনবলের চরম সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবায় সীমাহীন ভোগান্তি, দালালের দৌরাত্ম্য, বেসরকারি ক্লিনিকের লাগামহীন বাণিজ্যের কারণে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে সব মিলিয়ে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২১টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ১৬টি চিকিৎসকের পদ। চারজন মেডিকেল অফিসার এবং একজন জরুরি বিভাগের ডাক্তার দিয়ে চলছে একশ’ বেডের সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালটি।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে আরও জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি) একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিক সার্জারি) একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু) একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়েট্রিক) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (বিষয়বিহীন) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি) একজন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) একজন, মেডিকেল অফিসার দুইজন, মেডিকেল অফিসার (জরুরি বিভাগ) দুইজন, মেডিকেল অফিসার আয়ুর্বেদিক (উন্নয়ন) একজন ও রেডিওলজিস্ট একজনের পদ দীর্ঘদিন শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সিনিয়র চিকিৎসকের কয়েকটি পদ শূন্য রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
সদর হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স ২৫ জন, স্টাফ নার্স তিনজন, সহকারী নার্স একজন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ল্যাব) একজন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান (রেডিও) একজন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ডেন্টাল) একজন, স্টোরকিপার একজন, টিকিট ক্লার্ক একজন, ড্রাইভার একজন, পাম্প মেশিন অপারেটর একজন, এমএলএসএস দুইজন ও সুইপার তিনজনের পদ শূন্য রয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সার্জারি, গাইনি, চক্ষু, ইএনটি-সহ অন্যান্য বিভাগে রোগী থাকলেও নেই অভিজ্ঞ চিকিৎক। ফলে ধার করা চিকিৎসকের কাছ থেকেই নিতে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। মেডিকেল অফিসার এবং ধার করা চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ডাক্তার না পেয়ে সীমাহীন হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক রোগী ও তার স্বজনরা।
তারা বলেন, জেলার ২২ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান আশ্রয়স্থল সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল। কিন্তু এখানে তেমন অভিজ্ঞ চিকিৎসক নেই। দীর্ঘদিন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকলেও এ বিষয়ে এখানকার জনপ্রতিনিধিরা কোনো ভূমিকা রাখেন না। এটা খুবই দুঃখজনক।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহিম বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার মান এক সময় খুবই ভালো ছিল। তখন জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসতেন। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসকের চরম সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবার মান অনেক কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা নামের আগে ডিগ্রি বসানোর জন্য সদর হাসপাতালে থাকতে চাচ্ছেন না। বিভিন্নভাবে দেন-দরবার করে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। আবার সেখানে গিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্রাকটিসে নিয়োজিত হচ্ছেন। ফলে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শুধু চিকিৎসকরা নন, চিকিৎসকের যে সব অ্যাসিসট্যান্ট ছিলেন তারাও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। যেকারণে তেমন কোনো সেবা পাচ্ছেন না সদর হাসপাতালে আসা রোগীরা।
সদর হাসপাতালে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। এ কমিটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক আছেন। কিন্তু চিকিৎসক সংকট থাকলেও তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট মোকাবেলায় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ রোগী অন্তঃবিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকেন। এছাড়াও প্রতিদিন বহির্বিভাগ প্রায় সাড়ে চারশ’ এবং জরুরি বিভাগে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হয়। সব মিলিয়ে সদর হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় আটশ’ থেকে নয়শ’ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব রোগীকে সেবা দেওয়ার জন্য যে সব বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকার কথা, সে সব পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য হয়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘কিন্ত সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে এক-দুজন ডাক্তার ধার করে কোনোভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
বিভিন্ন কারণে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। সদর হাসপাতালের জনবল সংকটের বিষয়টি অধিদপ্তরে প্রতি মাসে জানানো হয়। ব্যক্তিগতভাবেও ডাক্তারের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এখানো কোনও ডাক্তার পাওয়া যায়নি। তবে, সম্প্রতি একটি নিয়োগ হয়েছে। এখান থেকে কিছু জনবল পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সিভিল সার্জন।