নিজস্ব প্রতিবেদক
সাম্প্রতিক সময়ে যে ই-কর্মাস সাইট নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা সেই ইভ্যালি নিয়ে এখন নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যেই ই-কমার্স সাইট ইভ্যালিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি এক টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় সাড়ে তিন টাকা। সম্পদের তুলনায় দেনা ছয় গুণ হওয়ায় তাদের টাকা পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সন্দিহান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইভ্যালির নিজস্ব কোনো পণ্য না থাকলেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের ওপর অবিশ্বাস্য সব ছাড় দিয়ে আসছে। কারণ তাদের কাছে যেন আরও বেশি গ্রাহক আসে।
আবার গণমাধ্যমকর্মীরা এদের নেগেটিভ রিভিউ যেন না দেয় সেজন্য সাংবাদিকদের জন্যে রাখা হয়েছে দ্রুত পণ্য ছাড়ের সুবিধা।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ আছে, কোনো পণ্যের জন্য গ্রাহক ইভ্যালিকে যে টাকা দেন, সেই টাকা চাইলেও আর ফেরত পান না। বাধ্য হয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের বদলে ‘আজেবাজে’ কোনো পণ্য কিনতে হয় টাকা উসুল করতে।
গ্রাহকদের টাকা ফেরত না পাওয়ার বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারণ একটা অ্যাকাউন্ট হয়। সেটা হলো ইভ্যালি ব্যালান্স বা ই-ওয়ালেট। এ ব্যালান্স কাস্টমার চাইলেই তুলতে পারেন না। ধরেন, কোনো কাস্টমার ৭০ হাজার টাকার একটা ফ্রিজ অর্ডার করলেন। কাস্টমার নানা ভোগান্তির শিকার হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করুক আর যাই করুক, রিফান্ড অন্য ইস্যু। যদি ইভ্যালির কারসাজিতে পড়ে সেলার আপনাকে বলে দেয় মাল ডেলিভারি দিতে পারবে না, তখন কাস্টমার বিরক্ত হয়ে যদি বলে দেয় অর্ডার ক্যানসেল, সে ক্ষেত্রে ব্যালেন্সটা ইভ্যালির হয়ে গেল।
‘টাকা তো ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেই সময় বাধ্য হয়ে কাস্টমাররা দুইটা মগ, জুতা-স্যান্ডেল হাবিজাবি কেনেন, যতটুকু পারে কিছু টাকা উসুল করার চেষ্টা করেন। অথচ মূল টাকাও ফেরত পাইল না, আবার প্রয়োজনীয় জিনিসটাও পাইল না। স্রেফ একটা চিটিংবাজির মধ্যে পড়ল কাস্টমার।’
তিনি বলেন, ‘বুঝলাম যে এটা ই-কমার্সের বিজনেস। কিন্তু সেলারকে টাকা না দিয়ে তাদের কাছে দেনা, আবার কাস্টমারের কাছ থেকে নগদ টাকা বুঝে নেয়া- এটা আবার কেমন ব্যবসা? লোভনীয় অফারের সুযোগ দিয়ে কাস্টমার ও কোম্পানিকে ঠকানো ছাড়া আর কিছুই না। আমার মনে হয়েছে, বিষয়টা কই মাছের তেলে কই মাছ ভাজা নয়, যেন ইলিশ মাছ ভাজা।’
এক পণ্যের বদলে অন্য পণ্য দেয়ার বিষয়টি প্রতারণার মধ্যে পড়ে এবং প্রচলিত আইনেই (দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায়) প্রতারণার জন্য শাস্তি আছে বলে প্রভাতী সংবাদকে জানিয়েছেন হাই কোর্টের আইনজীবী জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র।
তিনি বলেন, ‘প্রতারণা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের কারাদণ্ড। আছে জরিমানার বিধানও।’
পেইড রিভিউ
প্রতিষ্ঠানটির এই কর্মকর্তারা জানান, সবচেয়ে বড় প্রতারণার বিষয়টা হলো, ইভ্যালির পেজে যেসব রিভিউ দেয়া হয় তার সবই পেইড রিভিউ। ওদের একটা গ্রুপ আছে, সেই গ্রুপের নাম ইভ্যালি হেল্প অফার অ্যান্ড রিভিউ। সেখানে সাড়ে ৭ লাখ সদস্য। ওটার মধ্যে ইভ্যালির কর্মীরা রিপ্লাই দেন ফেইক আইডি খুলে। ওখানকার ৯৮ শতাংশ পোস্ট হলো পেইড পোস্ট।
তাদের একজন বলেন, ‘অনেক সময় আমাদেরকে অর্থাৎ ইভ্যালির কর্মীদের ব্যক্তিগত আইডি দিয়ে পোস্ট দেয়ানো হয় যে, ইভ্যালি থেকে যথাসময়ের মধ্যে আমার প্রোডাক্টটি বুঝে পেলাম। আজ আমি খুব খুশি। এমন পোস্ট দেয়া হয়। সেগুলোতে অনেক ভিউ হয়। নিজেদের বানানো পোস্ট। এসব মেইনটেইন করার জন্য ইভ্যালিতে ১২৫ কর্মী কাজ করেন। এসব ফেইক পোস্ট রিপ্লাই শুধু মানুষকে ইভ্যালির দিকে টানার জন্য। কারণ বেশির ভাগ অরিজিনাল রিভিউয়ে থাকে সমালোচনা।’
তারা জানান, ইভ্যালির সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার আরেক কৌশল তারকাদের উপহার দিয়ে পোস্ট দেয়ানো, যেগুলো আসলে পেইড পোস্ট।
উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেমন এর আগে ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির আর ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান যে পোস্ট দিয়েছিলেন ইভ্যালিতে, সেটা ছিল পেইড পোস্ট। তারা তাদের পেজে পোস্ট লিখেছিলেন, আমি খুব অল্প সময়ে পেয়ে গেছি, অন টাইমে পেয়ে গেছি, ধন্যবাদ ইভ্যালি। তাদের ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুকে এগুলো আছে।’
সালমান মুক্তাদির ও মুস্তাফিজুর রহমান আসলে ইভ্যালি থেকে মোটরসাইকেল ক্রয় করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মোটরবাইক গিফট করে পোস্ট দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল, যাতে সবাই আকৃষ্ট হয়। এই সুযোগে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা জড়ো করতে পারে ইভ্যালি। মানুষ তো আর এসব পেইড পোস্টের হিসাব বুঝবে না।
‘তার মানে কিন্তু ভিআইপিদের সঙ্গে সঙ্গে পণ্য দেয়া, বিষয়টা এমন না। ডিল হয় যে, আমরা তোমাকে এই গিফট দেব, পরিবর্তে আপনার ফেসবুকে ইভ্যালি থেকে প্রোডাক্টটি পেয়েছেন- এমন একটি পোস্ট দিতে হবে। এভাবে পাবলিকের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।’
সাংবাদিকদের জন্য আলাদা তালিকা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিকদের জন্য আলাদা তালিকা রয়েছে। তালিকায় থাকা সাংবাদিকরা অফারে কোনো কিছু অর্ডার করলে ৪৫ কর্মদিবসের আগেই প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিয়ে দেয়া হয়, যাতে নেগেটিভ কোনো নিউজ না হয়।
বিষয়টি দেখভালের জন্য একটা টিম রয়েছে। টিমটি বিভিন্ন হাউসের যেসব সাংবাদিক ইভ্যালির কাস্টমার তাদের নির্ধারিত সময়ের আগেই সার্ভিস দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
শবনম ফারিয়ার বলেন, ‘পিআর ডিপার্টমেন্টে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের অন্যান্য কর্মীদের দ্রুত দেওয়ার ।
‘এই লিস্টের গ্রাহকদের পণ্য আমি জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়ে দেই। সাইক্লোন অফারের ক্ষেত্রেও আমি এই গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, অনেকেই ডাউট করছে, সাইক্লোন অফ হয়ে গিয়েছে, এখন আমাদের পণ্য আদৌ পাব কি না- এ রকম একটা ডাউট সাধারণ মানুষের মধ্যে হচ্ছে। এটাকে আমি স্বাভাবিক মনে করি।’
সাংবাদিকদের পণ্য সরবরাহ দ্রুত হলেও হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে কেন- জানতে চাইলে শবনম ফারিয়া বলেন, ‘এই বিষয়টা আমার ডিপার্টমেন্ট না। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
কম দামে পণ্য বিক্রয় যেভাবে
ইভ্যালির ওই তিন কর্মকর্তা জানান, মোটরবাইকের ক্ষেত্রে যেটা বলা হয়ে থাকে এত কম টাকায় বাইক দেয় কীভাবে? একটা ৫ লাখ টাকার বাইক ৩ লাখ টাকায় কীভাবে বিক্রি করে? যেখানে ওই বাইকটার দাম আসলে সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
এ ক্ষেত্রে ইভ্যালি এভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা একসঙ্গে অনেক বাইক আনে। তাদের ওয়্যারহাউস আছে। সুতরাং তাদের বাইকের দাম কম পড়ে, কম টাকায় দিতে পারে। কিন্তু আসল কথা হলো বাইকের যন্ত্রপাতির তো মিনিমাম একটা মূল্য আছে, ৪ লাখ ২০ হাজার। তার চেয়ে কম দামে কীভাবে ইভ্যালি বাইক বিক্রি করতে পারে?
ঘাটতির টাকা কীভাবে ম্যানেজ করে
কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে ইভ্যালি এই ঘাটতির টাকা কীভাবে ম্যানেজ করে? এ ক্ষেত্রে তারা চালাকি করে যে, তারা বাইকের জন্য যে টাকা কাস্টমারের কাছ থেকে অ্যাডভ্যান্স নেয়, সেই অ্যাডভান্সের টাকাটা অন্যভাবে অন্য বিজনেসে বিনিয়োগ করে। সেটা তারা কাউকে বলে না বা প্রকাশ করে নাই এখন পর্যন্ত।’
গ্রাহকের টাকায় কোম্পানি
কাস্টমারদের এসব টাকায় সম্প্রতি তারা ফ্লাইট এক্সপার্ট নামে একটা ট্রাভেল এজেন্সি কিনেছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি জেনেছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে তারা আরও ছয়টি কোম্পানি কিনবে। যতটুকু শুনেছি, এগুলোর মধ্যে ই-হেলথ, ই-এগ্রো, ই-ফার্মা রয়েছে।
‘আমার জানামতে, ৬০ হাজারের মতো অর্ডার ঝুলে আছে ইভ্যালিতে। এর মধ্যে তিন হাজার মানুষের অর্ডার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এক বছরের বেশি সময়, যেগুলো দেড় মাসে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল। এদের বেশির ভাগের অর্ডার প্রথম ছয় মাস ঝুলিয়ে রাখা হয় সেলারের কাছে প্রোডাক্ট নাই বলে। বাকি ছয় মাস পার করেছে রিফান্ডের কথা বলে। কিন্তু কোনো কিছুই হয় নাই।’
পুরো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কোনোভাবেই তিনি সাড়া দেননি।