জাহাঙ্গীর নোমান
আমাদের পাঠ্যবই প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতদের যতটা ফোকাস করে ঠিক ততটাই প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতদের অবজ্ঞা করে। অথচ প্রাচীন ভারতে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশিই জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা হয়েছে।
ভাষা ও ব্যাকরণ, কাব্যচর্চা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, রাষ্ট্রচিন্তা, দর্শনচর্চা, যোগব্যায়াম কোথায় নেই তাঁদের অবদান।
মহামতি চাণক্যের কথাই ধরেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের মতো বৃহৎ এক সাম্রাজ্যই তাঁর হাত দিয়েই গড়ে উঠলো। সেই সাম্রাজ্য পরিচালনা, নীতিনির্ধারণ ও বহির্সাম্রাজ্যের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ সব তাঁর মাধ্যমেই হতো।
চাণক্যের পরামর্শে সেলুসিদ সাম্রাজ্যের অধিকর্তা সেলুকাসের দরবারে ৫০০টি যুদ্ধ হস্তি পাঠান চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং প্রত্যুত্তরে অঢেল উপঢৌকন দিয়ে মেগাস্থিনিসকে স্থায়ী রাজদূত করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারে পাঠান সেলুকাস।
চাণক্যের রাষ্ট্র বিষয়ক নানা বাণী এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বৈদেশিক নীতি নিয়ে তাঁর অর্থশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বাক্য হচ্ছে, ‘Every neighboring state is an enemy and the enemy’s enemy is a friend.’
আবার ধরেন বরাহ মিহির, আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের কথা। সম্রাট বিক্রমাদিত্যের দরবারে নবরত্নের একজন বরাহ মিহির ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
নিউটনের বহু আগে মধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravity) এর অস্তিত্বের কথা তিনিই প্রথম বলেন। তাঁর জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পঞ্চ সিদ্ধান্ত’। এছাড়া তাঁর লেখা ‘বৃহৎ সংহিতা’ পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো এনসাইক্লোপিডিয়া।
বরাহ মিহিরের গুরু আর্যভট্ট যতটা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন তারচেয়ে বেশি ছিলেন গণিতবিদ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আর্যভট্টীয়া’তে তিনি পাই (π) এর মান, শুন্যের ধারণা এবং চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
কোপার্নিকাসের হাজার বছর আগে আর্যভট্ট পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরে সে ব্যাপারে বলে গেছেন। আর্যভট্টের আরেক উত্তরসূরি ব্রহ্মগুপ্ত যিনি ‘শূন্য’কে সরাসরি একটি নাম্বার হিসেবেই ব্যবহার করেছেন।
তাঁর ‘ব্রহ্মগুপ্তস্ফূতসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে n সংখ্যক নাম্বারের ব্যবহার, বর্গ ও বর্গমূল, ঘন ও ঘনমূলের ব্যবহার দেখিয়েছেন। এছাড়া ভাস্করাচার্য, মহাবীরাচার্যেরও অবদান রয়েছে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে।
পৃথিবীকে প্রথম যিনি ব্যাকরণ শাস্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি হচ্ছেন পাণিনি। সিন্ধু নদীর তীরে তাঁর বসবাস ছিল। ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার ভাষিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অষ্টাধ্যায়ী’ যেখানে ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব সহ ব্যাকরণের প্রায় ১৭০০ নিয়ম-নীতি নিয়ে আলাপ করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর ভিত্তি করে প্রণীত বলেই আমাদের কাছে এত কঠিন লাগে।
কালিদাস ছিলেন গুপ্ত সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের অন্যতম রত্ন। পাণিনি ধ্রুপদী ধারার সংস্কৃত ভাষাকে ব্যাকরণবদ্ধ করে যাওয়ার পরে কালিদাস সংস্কৃত ভাষায় কালোত্তীর্ণ সব সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত নাট্যগ্রন্থ ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘদূতম’। এছাড়া আরো অনেক মূল্যবান নাট্যগ্রন্থ ও কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন মহাকবি কালিদাস।
কণাদ ছিলেন মূলত পদার্থবিদ যিনি প্রথম ‘কণা’র ধারণা বা পরমাণুর ধারণা দেন। তাঁর ‘বৈশেষিকা সূত্রে’ উল্লেখ করেন যে পদার্থের ৬টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলো হচ্ছে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সমন্বয়, বিশেষ্য ও সামব্যয়। এছাড়া রসায়ন শাস্ত্রে নাগার্জুনের ‘রসরত্নকর’ গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ।
তক্ষিশিলা বিহারের গ্রাজুয়েট ছিলেন সশ্রুত। চিকিৎসা শাস্ত্রে সশ্রুতের ‘সশ্রুত সংহিতা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে বলা হয় সার্জারির জনক, এমনকি প্লাস্টিক সার্জারিও জনক। ১১০০ ধরনের রোগ, ২৬ ধরনের জ্বর, ৮ ধরনের জন্ডিস, ২০ ধরনের মূত্রনালীর সমস্যা এবং ৭৬০ ধরনের বৃক্ষমূল ও ভেষজ ঔষধের কথা বলেছেন তাঁর সশ্রুত সংহিতায়।
সশ্রুতের শিষ্য চরক ছিলেন কানিশকার রাজ্যের রাজ বৈদ্য। তাঁর ‘চরক সংহিতা’ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার নানা ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছেন। যোগব্যায়ামে মহাঋষি পতঞ্জলির অবদান অবিস্মরণীয়। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে পতঞ্জলির কথা উল্লেখ করেছেন। যোগব্যায়ামের উদ্ভাবক পতঞ্জলি যোগব্যায়ামের ১৯৫টি সূত্র উদ্ভাবন করে গেছেন।
কামসূত্রের কথা অবশ্য বাঙালি মাত্র জানে বা শুনেছে।এই কামসূত্রের উদ্ভাবক দার্শনিক বাৎস্যায়ন যিনি কামরূপ রাজ্যের সভাসদ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন ভারত যৌনবিজ্ঞানেও যে অগ্রদূত ছিল তা বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’র মাধ্যমে বুঝা যায়। বরাহ মিহির তাঁর এনসাইক্লোপিডিয়া ‘বৃহৎ সংহিতা’য় কামসূত্র ও বাৎস্যায়নের কথা উল্লেখ করেছেন।
শিল্প-সংস্কৃতিতেও প্রাচীন ভারত অনেক এগিয়ে ছিল। ‘ভারতনাট্যম’ যে নৃত্য সেটার পেছনে যৌথভাবে অবদান রয়েছে ভরত মুণি ও নন্দিকেশ্বরের। সংগীতজ্ঞ ভরত মুণি তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’ ও নন্দিকেশ্বর তাঁর ‘অভিনয় দর্পণ’ গ্রন্থে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
ভারতনাট্যম এখন জগদ্বিখ্যাত। আর নন্দনতত্ত্বের জন্যে অভিনবগুপ্তের ‘অভিনবভরতি’ গ্রন্থটি মূল্যবান। এই তিনজন ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতির পথিকৃৎ বলা যায়।
সবমিলিয়ে বলা যায় ভারতীয় সভ্যতায় পৃথিবীর অনেক সভ্যতার চেয়েও বেশি জ্ঞানচর্চা হয়েছে এবং তৎকালীন সম্রাটরাও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও এর পূর্বে ভারতবর্ষের সব অর্জনের জন্যে অবশ্যই আমাদের গর্ববোধ করা উচিত।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় জ্ঞানী-গুণীদের অবদান শুধু তাদের মহিমান্বিত করে তা নয় বরং তাদের উত্তরসূরী হিসেবে আমাদেরও গর্বিত করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আমাদের প্রজন্মকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে এদের জীবনালেখ্য ও অবদান আমাদের পাঠ্যবইয়ে গুরুত্বসহকারে লেখা উচিত।
লেখক: ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক