প্রশান্ত কুমার
শিক্ষার মানের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। এটা স্রেফ গ্রাজুয়েট তৈরির কারখানা ছিল না। গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যঙ্গ করে এঁকেছিলেন একদল যুবক ব্যাগ কাঁধে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে আর পিঠে বিএ ডিগ্রি ছাপমারা ন্যূজ্ব শীর্ণ দেহ নিয়ে ফিরছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ড. অমলেন্দু বোস যিনি পরবর্তীতে অক্সফোর্ড থেকেও ডিগ্রি নেন এবং কলকাতা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি বলেছেন গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ব্যঙ্গচিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল না।
তিনি তাঁর “স্মৃতির ধূসর সরণিতে” লিখেছেন, “…….ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরন্তর অগ্রসরমান, এখানে ব্যক্তিত্বের সংযত বিকাশের অমূল্য সুযোগ, এখানে জ্ঞানপথিক যুবজনচিত্তে ক্রমেই এগিয়ে যায়, তার জীবনের মন্ত্র, উপনিষদের ভাষায় চরৈবেতি, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো….।
ড. অমলেন্দু বোসের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক অন্তহীন আলোকিত মনোজগতে বিচরণ করা জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন পিজে হার্টগ। অক্সফোর্ডের মডেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে অবশ্যই কোনো না কোনো হলে এটাচড থাকতে হতো। হলগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটা কলেজের মতো। সেখানে টিউটোরিয়াল হতো। ছাত্র শিক্ষক একসাথে থাকাতে সার্বক্ষণিক জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ ছিল।
ড. অমলেন্দু বোস যখন অক্সফোর্ডে গেছেন তখন তিনি অক্সফোর্ডেও এমন ব্যবস্থা দেখে অবাক হয়েছেন। এবং তিনি মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে “অক্সফোর্ড অফ দি ইস্ট” বলা হয় তা অতিরঞ্জন নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক হল নামে একটা হল আছে। হলটি বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। বিদেশি শিক্ষার্থী না থাকাই পিএইচডি কিংবা এমফিলের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যবহার করে বলে শুনেছি। আন্তর্জাতিক হলটি যে পিজে হার্টগের নামে নামকরণ করা তা অনেকে জানে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার আগে হার্টগ সাহেব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ বছর রেজিস্ট্রার ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিষয় স্যাডলার কমিশনেও তিনি ছিলেন।
ধর্মে ইহুদি হার্টগ সাহেব মূলত একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পরীক্ষা-বিশেষজ্ঞ। তিনি সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে। হার্টগের স্ত্রী ম্যাবেল হার্টগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সে সময় ঢাকায় আর কোনো ইহুদি পরিবার ছিল না।
স্বাভাবিকভাবে ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগ-ও ছিল না। মিসেস হার্টগ ঢাকায় অন্যান্য খ্রিস্টানদের সাথে মিশতেন। আর তাঁর বেশিরভাগ সময় কেটে যেত ঢাকা ক্লাবে। তিনি কয়েকটি বই-ও লিখেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে পিজে হার্টগের অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি বাস্তবিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড অফ দি ইস্ট করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য শুধু সুপারিশের ভিত্তিতে নয়, নিজে প্রার্থীদের সাথে কথা বলে নিয়োগ দিতেন। পিজে হার্টগ গবেষণার জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করতেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ ভিসি রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর “জীবনের স্মৃতিদীপে” আত্মজীবনীতে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পরেই তিনি তাঁকে বাংলার ইতিহাস লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এমনকি মি. মজুমদার যখন ইউরোপে যান উচ্চতর গবেষণার জন্য তখন তাঁকে ত্রিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল বই কেনার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটি অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রথম ভিসি হার্টগ সাহেবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর জার্মান, ফরাসি এবং ইংরেজি শিক্ষার মান সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা” গ্রন্থে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌভাগ্য যে এটি শুধু একজন শিক্ষা-বিশারদই ভিসি হিসেবে পায়নি, পেয়েছে একজন দক্ষ শিক্ষা সংগঠককেও। তিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ শিক্ষা-সংগঠক ছিলেন।
আগেই বলেছি পিজে হার্টগ একজন পরীক্ষা-বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল উপমহাদেশের অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মানসম্মত। পরীক্ষার খাতা দুইজন পরীক্ষক কর্তৃক মূল্যায়িত হতো। পরীক্ষকেরা খাতায় দাগ দিতে পারতেন না। আলাদা একটা কাগজে নম্বর লেখা হতো। দুই পরীক্ষকের মূল্যায়নের মধ্যে ব্যবধান দশ শতাংশের বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন করতেন। পরীক্ষার্থী মূল্যায়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেও সংশ্লিষ্ট করা হতো।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সরদার ফজলুল করিমের সাথে এক আলোচনায় বলেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাটা ছিল স্যাকরেড বা পবিত্র। তাতে ইন্টারফেয়ার করার মতো কোনো অবস্থা ছিল না।
রমেশ চন্দ্র মজুমদার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, খাজা নাজিমুদ্দিনের ছোটভাই শাহাবুদ্দিন মাত্র কয়েক নম্বরের জন্য অনার্স পাননি। মজুমদার মনে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে এটা সম্ভব ছিল না। অবশ্য শিক্ষকদের কাছে ১০ মার্কস বরাদ্দ থাকত। তাঁরা ইচ্ছা করলে কাওকে দিতে পারতেন। শিক্ষকরাও থাকতেন যথেষ্ঠ নীতিবান। যে প্রথম শ্রেণী পাওয়ার যোগ্য তাকে প্রথম শ্রেণীই দেওয়া হতো।
আব্দুর রাজ্জাক স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, মযহারুল নামের এক শিক্ষার্থী মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম শ্রেণি পাননি। তখন এটাকে অনেকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস করেছে। মযহারুল সাহেবের এগজামিনার ছিলেন একজন হিন্দু শিক্ষক। তাই স্বাভাবিকভাবেই আঙ্গুল উঠতে পারে। কিন্তু এর সবকিছু নাকচ করে দিয়ে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, মযহারুল দ্বিতীয় শ্রেণি পাওয়ারই যোগ্য ছিল। মযহারুল মূলত পেয়েছিলেন ২৯৪। তার সাথে শিক্ষক পাঁচ বাড়িয়ে ২৯৯ করে দিয়েছেন। উনি প্রথম শ্রেণি পাওয়ার যোগ্য হলে প্রথম শ্রেণীই পেতেন।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ছিলেন কিন্তু শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ হয়নি। বরং মুসলিম শিক্ষার্থীরা ভালো করলে তাঁরা খুশি হতেন।
প্রথম তিন দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় অনেক দক্ষ হিন্দু শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রকার মেধাশূন্যতা দেখা দেয়।
এই ভ্যাকুয়াম কাটিয়ে উঠতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সময় লাগছে। এই ভ্যাকুয়াম কাটিয়ে উঠেছিল ষাট এবং সত্তরের দশকে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষককে হত্যা করে। ফলে আবার ভ্যাকুয়াম শুরু হয়।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মতে, এখনও ইউনিভার্সিটিতে মানসম্মত শিক্ষক রয়েছেন। বরং আগের চেয়ে এখন পিএইচডি হোল্ডার বেশি। কিন্তু আগের শিক্ষকদের মতো এখনকার শিক্ষকদের সেন্স অফ রেস্পন্সিবিলিটি কম। কমিটমেন্ট নাই। শিক্ষকরা এখন চাকরি করেন, শিক্ষকতা করেন না।
১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই পিজে হার্টগ ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম ১৮৬৪ সালের ২ মার্চ। শোনা যায় পিজে হার্টগের বংশধররা কেউ কেউ এখনও কলকাতাতে থাকেন।
কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ অনেক চেষ্টার পরেও তাঁদের খুঁজে বের করতে পারেননি। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রসারে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করণের ক্ষেত্রে পিজে হার্টগের ভূমিকা অসামান্য।
তথ্যসূত্র:
১)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা, সরদার ফজলুল করিম
২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, রফিকুল ইসলাম
৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, সৈয়দ আবুল মকসুদ
৪) জীবনের স্মৃতিদীপে, রমেশ চন্দ্র মজুমদার