নিশাত বিজয়
সারা বিশ্বের মুসলিমদের সর্ববৃহৎ উৎসব ঈদুল ফিতর। এবার ঈদুল ফিতর যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন করোনা ভাইরাসে সারাবিশ্ব আক্রান্ত। আর এই সময়ে করোনা ভাইরাস ছাড়াও সামরিক শাসক কিংবা ধর্মীয় উগ্রপন্থী দ্বারাও বেশকিছু জনগোষ্ঠী আক্রান্ত।
বিশ্বের সামনে গত ১০০ বছর ধরে সবচেয়ে চর্চিত ও অমীমাংশীত বিষয় হচ্ছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। ইসরাইলী ইহুদী জাতিগোষ্ঠী জায়োনিস্ট মুভমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করে।
তাদের পবিত্র ভূমি দাবি করে ফিলিস্তিদের অনেকের থেকে জমি কিনে আবার অনেক জমি দখল শুরু করে। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে জায়োনিস্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহ বিভিন্ন এলাকা দখল করতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুটো আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। সেখানে ইহুদীদের মাত্র ২০ শতাংশ জমি থাকলেও তাদের ৫৫ শতাংশ ও ফিলিস্থিনিদের ৪৫ শতাংশ জমি দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই আর রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য ফিলিস্তিনি মাত্রই মুসলিম নয়। বরং খ্রিষ্ঠান ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের লোকেরা ফিলিস্তিনি এবং তারা জায়োনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী। একইসাথে ইহুদীদের অপরগোষ্ঠী জুদাইজম অনুসারীরাও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং ইসরাইল বিরোধী।
আবার বর্তমান ইসরাইল রাষ্ট্র ইহুদীবাদী জায়োনিস্টদের হলেও সেখানে ১৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি মুসলিম ও ৫ শতাংশের মতো ফিলিস্থিনি খ্রিষ্টান ও দ্রুজ সম্পদায়ের বাস।
বেলফোর ঘোষণার বয়স একশ বছর হলেও এই অঞ্চলের সংঘাতের ইতিহাস ৬ হাজার বছরের পুরাতন। এসময় থেকেই এখানে ইসরাইল জাতি ও ফিলিস্তিন জাতির আবাস। ইসরাইলী জাতি আদি থেকেই সেমিটিক ধর্মের অনুসারী ইহুদী ও একসময় পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারী ছিল ফিলিস্তিনিরা। পরে ফিলিস্তিনিরা অনেকে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও দ্রুজ ধর্ম গ্রহণ করে।
ইসরাইলী জাতির আদিপিতা ডেভিডের সন্তান সোলেমান একটি প্রার্থনাগার তৈরি করেন, যেটির নাম টেম্পল মাউন্ট। পরে ব্যবিলনের রাজা নেঁবুরনেজাদ এটি ধ্বংস করেন এবং সেখান থেকে ইহুদিদের উচ্ছেদ করলে, তারা আস্তে আস্তে এক সময় পারস্যে বসতি স্থাপন করে। পারস্যের আকামেনিদ সম্রাজ্যের রাজা সাইরাস দ্যা গ্রেট তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিয়ে প্রার্থনাগার তৈরি করে দেন।
এরপর রোমানরা এ অঞ্চল দখল করে ইসরাইলীদের প্রার্থনাগার দ্বিতীয়বারের মতো ধ্বংস করে দেয়। ইহুদীরা তখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকবার তারা গণহত্যার শিকার হয়। মক্কা, মদিনা তায়েফে সপ্ত দশকে গণহত্যার শিকার হয়, ইউরোপেও বেশ কিছু জায়গা থেকে তাদের মধ্যযুগে উৎখাত করা হয়, তারপর নতুন কোন ভূমিতে আবার বসতি গড়ে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সময় রোমান গণহত্যার ২ হাজার বছর পরে আবার বড় একটি গণহত্যার স্বীকার হয় জার্মানিতে। ঠিক এসময়ই বিশ্ববাসীর আবেগকে পুজি করে গঠিত হয় জায়োনিস্ট ইসরাইলী রাষ্ট্র।
এই ইসরাইলী রাষ্ট্রের শুরু থেকেই বিরোধী ছিল আরবের জাতীয়তাবাদী শক্তি সহ বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মনিরেপেক্ষ শক্তি। এখানে স্মরণ করে দেওয়া প্রয়োজন যে, আরব জাতীয়তাবাদের জনক মিশেল আফলাক একজন খ্রিষ্টান ছিলেন। তার নেতৃত্বে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, মিশর, আলবেনিয়া, সুদানে আরব জাতীয়তাবদীরা ক্ষমতায় আসে। এই রাষ্ট্রগুলো শুরু থেকেই ধর্মভিত্তিক ইসরাইলী রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই ফিলিস্তিনে ২ জুন, ১৯৬৪ সালে ফাতাহ গঠিত হয় ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে। ধর্মনিরেপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে ফাতাহ গঠিত হলে জোট নিরেপেক্ষ আন্দোলনের বিশ্ব নেতৃত্ব সহ সারাবিশ্বের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইয়াসির আরাফাত। ইয়াসির আরাফাতের পক্ষে সারাবিশ্ব থেকেই তরুণেরা গিয়েছিল যুদ্ধে।
ইয়াসির আরাফাত, বিল ক্লিনটন ও ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয় কম অত্যাচারী শাসক শিমন পারেজ ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে সমাধানের দ্বারপ্রান্তে এসেছিলেন। কিন্তু শিমন পারেজের পরিবর্তে ইসরাইলে ক্ষমতায় আসে উগ্রবাদী নেতা নেতানিয়াহু। তারপর সব ভেস্তে আসে।
ভেস্তে আসার অন্যতম প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে ইসলামিস্ট হামাস। ফাতাহ মুভমেন্টের যখন চুক্তির আলোচনা করেছে তখন হামাস হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ফলে দখলদার ইসরাইলী নতুন যুক্তি দেখাতে শুরু, নিজেদের কথিত আত্মরক্ষার নামে আবারও ফিলিস্তিনের উপর নিপীড়ন শুরু করে।
একই সাথে এ কথা পরিস্কার হওয়া দরকার যে, ইহুদী মাত্রই ইসরাইলের নাগরিক নয়। সারাবিশ্বে ২ কোটির অধিক ইহুদী সম্প্রদায়ের বাস
বিশ্বব্যাপী ইসলামিস্টদের বড় একটি সমস্যা এরা ভারতের সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে যখন হিন্দুত্ববাদী ট্যাগ দেয়, ইসরাইলকে ইহুদীবাদী জায়োনিস্ট বলে, মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গাদের উপরে হামলা হয় তখন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের কথা বলে কিন্তু এরা যে নিজেরা যখন ধর্মনিরেপেক্ষ আন্দোলনকে বাঁধাগ্রস্ত করে তখন এদের যখন ইসলামিস্ট বলা হয় তখন এটা বললে নাকি ইসলামকে অবমাননা করা হয়।
হিন্দুত্ববাদী বললে হিন্দু ধর্মের অবমাননা হয় না, বৌদ্ধ সন্ত্রাসী বললে বৌদ্ধ ধর্মের অবমাননা হয় না? বৌদ্ধ তো মানুষ দূরে থাক যে কোন প্রাণী হত্যায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাহলে কিছু বৌদ্ধের জন্যে বৌদ্ধ সন্ত্রাসী দল বলা হয় কেন বৌদ্ধদের? তার কারণ হচ্ছে ধর্মকে উপজীব্য করে যে সন্ত্রাসবাদ চালানো হয় সেটাকে সেই ধর্মের নামেই অবিহিত করা হয়। সেখানে সেই ধর্মকে নয় বরং ধর্ম ব্যবহার করে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, পুরো ধর্মকে বোঝানো হয় না।
সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা না করে শুধুমাত্র ঘৃণাকে উপজীব্য করে কোন সংকট কোনদিন মোকাবেলা করতে পারবে না। আর ফিলিস্তিন, কাশ্মীর আর আরাকানে এই সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমেরা ধর্মকে উপজীব্য করে।
কিন্তু সৌদি কর্তৃক ইয়েমেনে হামলা, তুরস্ক কর্তৃক সিরিয়ায় হামলা কিংবা নাইজেরিয়া আর আফগানস্তানে যখন আল-কায়েদা-তালেবান কর্তৃক স্কুলে হামলা করে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয় বা বিশ্বব্যাপী যখন দেশে দেশে জঙ্গি হামলা করা হয় তখন তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে নানান যড়যন্ত্র তত্ত্ব বললেও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের পরিবেশ যেন বন্ধ হয় সে নিয়ে এই সংখ্যাগরিষ্টরা কোন কথা বলে না।
তারা এটা ভাবে না যে, তারা যেমন করে এই ধর্মীয় উগ্রবাদকে লালন করে একইভাবে তো খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ আর ইহুদী উগ্রবাদীরাও তাদের ধর্মকে উপজীব্য করে উগ্রবাদ লালন করে। সেজন্য ফিলিস্থিন হোক আর ইয়েমেন হোক এই ধ্বংসলীনা বন্ধ করতে গিয়ে অবশ্যই ধর্মীয় উগ্রবাদকে জলাঞ্জলি দিয়েই মানুষ হিসেবে প্রতিটি জাতিস্বত্তার, প্রতিটি ধর্মের, প্রতিটি বর্ণের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে থাকতে হবে। তবে সার্বজনীন একটি বিশ্ব তৈরি হবে- যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতিতে বিভেদ থাকবে না, সবাই সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে।
একরোখা দৃষ্টিভঙ্গি নয় বরং বহুমাত্রিক চিন্তার জয় হোক। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষ জয় পাক। ফিলিস্তিন মুসলিম, ইহুদী, খ্রিষ্টান, দ্রুজ, ইয়াজিদি সব ধর্মের মানুষের সহবাস্থানের দেশ হয়ে উঠুক।