মুকুল আহমেদ
প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলে পরিবেশ ও কাঠামোতে নানান পরিবর্তন এসেছে। মাহফিলের সাজসজ্জায় নিত্য সৌন্দর্যবর্ধন চলছে। আলোকসজ্জা হচ্ছে মঞ্চে। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে থাকছে ধর্মভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান। আলেমরা বলছেন, ‘এসব পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক হওয়ায় ধর্মীয় এই প্রচার-পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আরও পড়ুন: “ইউরোপে মুসলিম নেই ইসলাম আছে, বাংলাদেশে মুসলিম আছে ইসলাম নেই”
জ্যেষ্ঠ আলেমরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের পর ওয়াজ মাহফিলের ধরন বদলে গেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আর্থিক জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছেন দেশের বেশিরভাগ বক্তা (যারা ওয়াজ করেন)। বাংলা অঞ্চলে ওয়াজের সূচনার সময় এই ‘নিশ্চয়তা’ অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল। যদিও এখন মাহফিলেই বক্তারা শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন নিজেদের বাড়ি-গাড়ির কথা। ওয়াজ থেকে প্রাপ্ত সম্মানীর মাধ্যমে কোনও কোনও বক্তার মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।
আরও পড়ুন: ‘যে নারী পুরুষের সঙ্গে পাবলিক বাসে উঠে, ইমাম মাহাদীর বিরুদ্ধে এরাই যুদ্ধ করবে’
মাইক-ডেকোরেটর ব্যবসায় আয়ের একটি বড় মাধ্যম ওয়াজ মাহফিল। এ আয়োজনকে ঘিরে গত কয়েক বছরে ভিডিও প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। যারা পেশাগতভাবে ওয়াজের ভিডিও নির্মাণ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ওয়াজের প্রচারণা চালায় তারা। এসব ভিডিও ইউটিউবে আপলোডের মাধ্যমে আসতে থাকে কিছু অর্থকড়ি।এক সময় ওয়াজ মাহফিল গুলোতে মাইকের ব্যবহার ছিলো হারাম।ভিডিও করা ছিলো হারাম।
আরও পড়ুন: তোহা আদনানের দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানতো না পরিবার
ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী সংগীত শিল্পীগোষ্ঠীও তৈরি হয়েছে, যারা মাহফিলে ‘সম্মানী’র বিনিময়ে হামদ-নাত ও ধর্মীয় উৎসাহব্যঞ্জক গান পরিবেশন করে থাকে।কিন্তু এই গুলো ইসলামে নিষেধ ছিলো।
হাদিসের এক শিক্ষক উল্লেখ করলেন কোরআনের সূরা লোকমানের ১৩ নম্বর আয়াতের কথা। এতে বলা হয়েছে, “আর স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন লোকমান তার পুত্রকে ওয়াজ (উপদেশ) করতে গিয়ে বললো, ‘হে পুত্র আমার! আল্লাহর সঙ্গে শিরক কোরো না, নিঃসন্দেহে শিরক মহাঅপরাধ।’ (সূরা: লোকমান, আয়াত: ১৩)।”
আরও পড়ুন: ত্ব-হা যে বন্ধু সিয়ামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো সে হারালো চাকরি
মুফতি লুৎফুর রহমান বলেন, ‘ওয়াজ ও নসিহতের ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন: স্বল্পবসন পুরুষ দেখলেও নারীর মন চঞ্চল হয়: ইমরান খানকে তসলিমা
একশ্রেণির বক্তারা সম্মানী নিয়ে দরকষাকষি করেন, এমন তথ্য কোনও কোনও আলেম জানালেও তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে মাহফিলেই চরমোনাইপন্থী বক্তা মাওলানা শামসুল হক শ্রোতাদের জানান, তিনি প্রতি ওয়াজে ৩০ হাজার টাকা করে নেন। তা না হলে তিনি মাহফিলে যান না।
ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে যুক্ত এমন অন্তত পাঁচজন আলেম আলাপকালে জানান, জামায়াতি ঘরানার একজন বক্তার সম্মানী প্রায় ৩লাখ টাকা! তিনি সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৪-৫ বছর আগেও এই বক্তা ওয়াজপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা সম্মানী নিতেন। ২০ দলীয় জোটভুক্ত ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতাও মাহফিলে যাওয়ার শর্ত হিসেবে সম্মানীর পরিমাণ জানিয়ে দেন। ভৈরবের একজন জনপ্রিয় বক্তা আছেন, যিনি সম্মানী প্রাপ্তি সাপেক্ষে মাহফিলের জন্য সময় বরাদ্দ দিয়ে থাকেন।
নরসিংদীর বক্তা মাওলানা মাজহারুল ইসলাম মাজহারী ওয়াজে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, তিনি ডিম বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। এখন তার কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ি সবই আছে। এ বিষয়ে ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থাকলেও তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি মাহফিলে মাওলানা শামসুল হক নওমুসলিম ওরফে রানা মাস্তান বলেন, ‘আমি প্রতি মাহফিলে ৩০ হাজার টাকা করে নিই। আমার মাদ্রাসা চালাইতে লাগে, তাই নিই আমি। আমারে দিতে পারলে নিবেন, না হলে কষ্ট হলে অন্য বক্তা দিয়ে করেন। আমি খুশি।’
মাওলানা শামসুল হকের মন্তব্য, ‘ওয়াজের বক্তাদের ফ্ল্যাট করতে বেশি সময় লাগে না! তিন দিনের বক্তাও ফ্ল্যাট কিনেছে ঢাকায়। একেক বক্তা ঢাকা শহরে কী ডাটে বাড়ি বানাইছে জানেন আপনারা? চাইলে এক মাসের ইনকাম দিয়া গাড়ি কিনতে পারি আমি। কিন্তু মাদ্রাসা পরিচালনা করতে গিয়ে পারি না।’
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী। দেশ ও দেশের বাইরে তিনি যুক্তিবাদী হিসেবে পরিচিত। কেবল ওয়াজ করেই চলছে তার পেশাগত জীবন। যদিও তিনি মাহফিলকে পেশা হিসেবে দেখতে নারাজ। হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়াকে পেশা হিসেবে নেওয়া ঠিক না। এখানে উদ্দেশ্য হতে হবে হেদায়েতের। মানুষকে ভালো ও সুন্দর কথা শোনাতে হবে। দেশ স্বাধীনের পরপরই ওয়াজ শুরু করেছিলাম। তবে কখনও চুক্তি করি নাই। বুঝিও না ব্যাপারটা। কিছু বক্তা আছে চুক্তি-টুক্তি করে।’
মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদের পর্যবেক্ষণ, ওয়াজ মাহফিলে আগের চেয়ে এখন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তিনি জানান, সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর শিষ্য মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর হাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের সূচনা হয় এই অঞ্চলে। ওয়াজ মাহফিলের প্রসার ঘটে তার সময়েই। তিনি সারাবাংলা চষে বেড়িয়েছেন। ওই সময় নৌকায় চড়েই তাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। এরপর তো দেওবন্দি ওলামাদের মাধ্যমে গোটা উপমহাদেশেই মাহফিল প্রসারিত হয়েছে। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর ও ঊনিশ শতকের শুরুতে সিলেটে ও চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার আগে কওমি শব্দটা ছিল না, আলেমরা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ জানান, ‘সাতচল্লিশে দেশভাগের আগে থেকেই মাহফিলের অবয়ব পাল্টাতে থাকে। পরস্পরায় স্বাধীনতার পর মাহফিল ইসলামি ভাবগাম্ভীর্য থেকে বেরিয়ে আসে। আগে যারা ওয়াজ করতেন তাদের ইলম, আমল, ত্বাকওয়া সবই ছিল। তাদের কোনও ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। নব্বই দশকের পর ওয়াজ মাহফিল বাণিজ্যনির্ভর হয়ে ওঠে। এখন এটি ব্যাপকতর আকার নিয়েছে।’
জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি মাওলানা মানসূরুল হক নিজের মাহফিলের বিষয়ে আয়োজকদের উদ্দেশে কিছু নিয়ম-কানুন জানিয়ে রেখেছেন। মাহফিল থেকে বিনিময়ের বিষয়ে তিনি আগ্রহীদের বলেন, ‘হক্কানী আল্লাহওয়ালা উলামায়ে কিরামকে দাওয়াত দেবে। বিশেষ করে যারা ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করেন না এমন বক্তাকে দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে প্রাধান্য দেবে। কারণ ওয়াজ করা আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)-এর কাজ। এ কাজের মাধ্যমে তখনই উম্মতের ফায়দা হয় যখন তা নবীদের (আ.) তরীকায় করা হয়। আর কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আছে, নবীরা (আ.) ওয়াজের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। তাঁরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ওয়াজ করতেন। (সূরায়ে ইয়াসীন: ২১ শু‘আরা: ১২৭)’
কওমি মাদ্রাসার আলেম ও সাংবাদিক লিয়াকত আলী তার এক প্রবন্ধে জানান— ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর বাংলায় ১৯০১ সালে হাটহাজারী, ১৯১১ সালে জিরি মাদ্রাসা, ১৯১৩ সালে ঢাকার তাঁতীবাজার মাদ্রাসা, ১৯১৪ সালে সিলেটের গাছবাড়ি মাদ্রাসা, ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়া ও ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলার গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা আর ঢাকার বড় কাটারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের চারিয়া মাদ্রাসা, ১৯৩৭ সালে পটিয়া মাদ্রাসা, ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসা ও ১৯৫০ সালে লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে আমাদের সমাজে নানা প্রবণতা শুরু হয়েছে, যা অনেক সময় ইসলামের মৌলিক আদর্শকেও ক্ষুণ্ণ করছে। এখন মহল্লায় মহল্লায় প্রতি রাতে মাহফিল হচ্ছে; কিন্তু কেন যেন মানুষের ভেতর জগতে পরিবর্তন আসছে না। মাহফিল শুনতে শুনতে জীবন-যৌবন শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটিও মরণ ভুলে, আল্লাহ-রাসূল ভুলে পাপের সাগরে ডুবে থাকছে।ইদানীং বিভিন্ন বক্তার বয়ানে গালাগালি, ধমকাধমকি, মিথ্যা, ঠাটবাট এবং অন্যকে অপমান করা, ছোট বানানোর নানা কথাবার্তা দিয়ে সাজানো থাকে; যা সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
মাওলানা আজাদীর ভাষায়, ওয়াজের মাধ্যমে আল্লাহভোলা বান্দাদের হৃদয়ের খোরাক দিতে হবে। আফসোস! আজ বাড়ি বাড়ি, মহল্লায়-মহল্লায় প্রতি রাতে মাহফিল হচ্ছে; কিন্তু মানুষর হৃদয়ে জগতে পরিবর্তন আসছে না। ওয়াজ আজ প্রেমহীন বাক্যালাপে পরিণত হয়েছে!
বি: দ্র: মুক্তমত কলামে প্রকাশিত লেখার দায় কেবলমাত্র লেখকের। প্রভাতী সংবাদ কর্তৃপক্ষ লেখার দায় বহন করবে না।