জাহাঙ্গীর নোমান
ভারতীয় মহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ১৮৫৩ সালে প্রথম রেললাইন চালু করলেও সিলেট-ছাতক রেলপথ স্থাপিত হয় পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে।
একসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ভৈরব হয়ে সুনামগঞ্জ-ছাতক-সিলেট-শিলচর স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। তারপর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় মূলত পাকিস্তানিরা রেললাইন চালু করে।
ছাতকে যেমন ছিল চুনাপাথরের ব্যবসা ঠিক তেমনি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, পেপার মিলসহ ছাতককে ক্রমশই একটা বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে উঠছিল আর গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল পূর্ব থেকেই।
বৃটিশ ভারতে রেললাইন স্থাপিত হয় যতটা না যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্যে তারচেয়ে বেশি লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক লুটপাটকে সমুদ্রবন্দরগুলোয় পৌঁছে জাহাজে তোলা।
তবে রেললাইন যতটা না যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা হয় তারচেয়ে বেশি ভারী পণ্য ও শিল্প কাঁচামাল পরিবহনে ব্যবহার করা হয়।
সাবেক রেলমন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাতকের এই রেলপথকে সম্প্রসারণ করে সুনামগঞ্জ – নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাতক-দোহালিয়া-সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ করার কথা ছিল।
এখন হঠাৎ করে শোনা যাচ্ছে মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী তাঁর এলাকা শান্তিগঞ্জকে (যা বাণিজ্যিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ) অন্তর্ভুক্ত করার নিমিত্তে গোবিন্দগঞ্জ থেকে জাউয়া-শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ রেলপথ নেওয়ার জন্যে সমীক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
অথচ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছাতক শিল্প, বাণিজ্য ও নদীবন্দরকে এড়িয়ে ওইপথে রেলপথ নেওয়া সরকারের জন্যে আর্থিকভাবে যেমন ব্যয়বহুল তেমনি বিনিয়োগ সফল নয়। রেলপথ তো কেবল যাত্রী পরিবহনের জন্যে সরকার স্থাপন করেনা, করলে সমুদ্র বন্দর পায়রা পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ করতো না।
এবার দেখা যাক ছাতক অর্থনৈতিকভাবে দেশের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকা-সিলেট-ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথও কতটা গুরুত্ববহ।
১৭৭৪ সালে এইচটি রাইট ও জর্জ ইংলিশ নামে দু’জন ব্রিটিশ নাগরিক ব্যবসার জন্য ছাতক শহরে এসে ‘রাইট ইংলিশ কোম্পানি’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তারা এ কোম্পানির মাধ্যমে ছাতক থেকে পাথর, চুন, তেজপাতা ও কমলালেবু সরবরাহ করতেন বৃটেনে।
এই চুনাপাথর মূলত মেঘালয় থেকে সরবরাহ করা হতো এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৭ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হিসেবে আসাম-বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি উৎপাদন শুরু করে ছাতকে।
এরপর ১৯৭৭ সালে কাঁচামালের সহজলভ্যতার জন্যে চালু হয় সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিল। ২০০৩ সালে ছাতকে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করে ফ্রান্সভিত্তিক লাফার্জ সিমেন্ট উৎপাদন গ্রুপ যা এখন সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক লাফার্জ-হোলসিম নামে পরিচিত।
এরপর আকিজ প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, নিটল-নিলয় পেপার মিলসহ নানা উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের যৌথ বিনিয়োগে সৌদি-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সিমেন্ট কোম্পানি নামে একটি আধুনিক সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশের বিসিআইসির সাথে ৩,০০০ কোটি টাকার যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। ২০১৯ সালে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার অনুরোধের প্রেক্ষাপটে ছাতক-মেঘালয় সীমান্তে ‘ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৯০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এতে মেঘালয়সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা হবে। কর্মসংস্থান হবে সুনামগঞ্জের বিপুল সংখ্যক মানুষের। আর এতে কাঁচামাল পরিবহনে রেলপথ সীমান্ত অবধি নেওয়া লাগতে পারে। ভবিষ্যতে শিলং পর্যন্ত যদি রেলপথ সম্প্রসারণের কোনো পরিকল্পনা করা হয় সেক্ষেত্রে এই রেলপথকে কাজে লাগানো সম্ভব।
সিলেট-ছাতক রেলপথের গোবিন্দগঞ্জ স্টেশন থেকে সুনামগঞ্জ স্টেশনের দূরত্ব হচ্ছে ৪৭ কিমি অথচ ছাতক স্টেশন থেকে সুনামগঞ্জ স্টেশনের দূরত্ব ৩২ কিমি।
অর্থাৎ সরকারকে অতিরিক্ত ১৫ কিমি দূরত্বের রেলপথ নির্মাণে ব্যয় করতে হবে যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যয়সংকোচন নীতির পরিপন্থী। তাছাড়া এই রুটে রেলপথ নির্মাণে বড় বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে, উঁচু রাস্তা বানাতে হবে এবং অধিক ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে যা সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে দিবে।
যেহেতু রেলপথ মূলত পণ্য পরিবহনের জন্য নির্মাণ করা হয় সেক্ষেত্রে ছাতক-দোহালিয়া-সুনামগঞ্জ রুটই রেলপথ নির্মাণের জন্যে সবদিক দিয়ে বিনিয়োগ সফল হবে। ঢাকা-সুনামগঞ্জ আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হলে ছাতক স্টেশন থেকে রাজধানীগামী যাত্রী যারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করে তাদের যাতায়াত সহজ হবে।
অন্যথায় তাদেরকে ১৩ কিমি দূরের গোবিন্দগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এছাড়া ছাতক স্টেশনকে বাদ দিয়ে শান্তিগঞ্জ হয়ে রেলপথ গেলে ছাতক রেলপথের উন্নয়নে রেল মন্ত্রণালয় উদাসীন থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সবমিলিয়ে ছাতক-দোহালিয়া-সুনামগঞ্জ রুটেই রেলপথ নির্মাণ সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতির প্রতিফলন ঘটবে।
লেখক: রাজনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক
বি: দ্র: এই লেখার দায় লেখকের, প্রভাতী সংবাদ কর্তৃপক্ষ এটার জন্যে দায়ী নয়।