আলমগীর শাহরিয়ার
ফেসবুকে কতই না তুচ্ছ বিষয় নিয়ে লিখি অথচ আমার মায়ের, আমাদের আম্মার একটা গৌরবের অর্জন নিয়ে কিছুই লিখিনি। নিজেকে বেশ অপরাধীই মনে হলো। অথচ কত নির্ভেজাল সত্য, সংগ্রাম আর শ্রমলব্ধ এ অর্জন, এ স্বীকৃতি।
হুমায়ুন আজাদ কী তাহলে ‘আমাদের মা’ কবিতায় যথার্থই লিখেছিলেন, “আমাদের মা গরিব প্রজার মতো”? গরিব প্রজার কথা ইচ্ছে হলে মনে পড়ে ইচ্ছে না-হলে পড়ে না। ইংরেজিতে তবু একটি কথা আছে, Late is better than never. ঢাকায় ফোনে এলার্ম দিয়ে রাখি। তবুও ঘুম ভাঙতে চায় না।
কিন্তু প্রকৃতির কি অদ্ভূত খেলা ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম রোজই খুব ভোরে প্রকৃতির জেগে ওঠা কোলাহলে ঘুম ভেঙে যায়। আম্মাও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। জন্মের পর থেকেই তাই দেখে আসছি। হালকা নকশী করা সুশ্রী শীতলপাটি বিছিয়ে আম্মা ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর অনুচ্চ সুরে শুভ্র-বসনা নারী চিরকালের বিশ্বাসী হৃদয় নিয়ে কোরান শরীফ তেলাওয়াত করেন। কী মধুর পবিত্র এক সংগীতের নীরব সুরলহরী চারিদিকে গুঞ্জন করে। বাড়িতে যেকদিন ছিলাম―ভোরের এ প্রার্থনা শেষ হলে―না-চাইতেই নিজ হাতে এক কাপ চা করে দিতেন। তারপর নাস্তার আয়োজন। বাড়িতে ছুটির আমেজে পছন্দের কজন লেখকের লেখা পড়ছিলাম। (পুনর্পাঠ―বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ গল্প, ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’।) তখনো চেনা চারপাশ থাকতো ঘুমে। কেননা, দুই দশক আগের গ্রামে সূর্য ডোবার পরে যে মানুষেরা সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়ত বহু বছর হলো সে গ্রামটি আর নেই। হারিয়ে গেছে নয়া-যান্ত্রিক কোলাহলে। তবু ভোরের আবহে জেগে উঠে দেখতাম পাখিরাই শুধু বিচিত্র ও মধুর সংগীতে ডাকছে, গাইছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথায়,
“পৃথিবীকে এক মায়াবী মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান গায় — গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।
এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপুর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।”
সত্যিই যেন তাই। নগরের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন থেকে দূরে ওইখানে কিছুদিন স্বর্গ মনে হয়। মায়ের জন্য আহামরি কিছু করতে পারি নাই। ঈশ্বরচন্দ্রের গল্পের মতো দামোদর নদী পাড়ি দিই নাই। তবু তাঁর বাৎসল্যের কমতি দেখি নাই কোনোদিন। পৃথিবীর সকল মায়েরাই সম্ভবত এমনই।
“আমি অকৃতি অধম ব’লেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।।
তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে,
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে;
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ,
প্রতিদান কিছু চাওনি।।
আমি ছুটিয়া বেড়াই, জানিনা কি আশে,
সুধা পান করে মরি গো পিয়াসে;
তবু যাহা চাই সকলি পেয়েছি;
তুমি তো কিছুই পাওনি।।
আমায় রাখিতে চাও গো, বাঁধনে আঁটিয়া,
শতবার যাই বাঁধন কাটিয়া।
ভাবি ছেড়ে গেছ, ফিরে চেয়ে দেখি,
এক পা-ও ছেড়ে যাওনি।।”
হে পরওয়ারদেগার, পিতাহীন এ সংসারে তুমি আমাদের মাকে দীর্ঘ জীবন দিও। তাঁর অপার মায়া আজো তপ্ত দুপুরে স্বর্গের মেঘের মতো ছায়া দেয়। পৃথিবীর সকল মায়েরা ভোরের সুন্দর পৃথিবীর মতো সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, সচল ও সজীব থাকুন। আকুল প্রার্থনা। ছবির সঙ্গে যুক্ত ক্রেস্টটি মায়ের সম্মান ও ছোট্ট একটি অর্জন যে গল্প বলব বলে এই লেখার পত্তন করেছিলাম।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে―ছাতক উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায়―আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস-২০১৯ উদযাপন উপলক্ষ্যে―”জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায়―সফল জননী নারী ক্যাটাগরীতে―উপজেলা পর্যায়ে #শ্রেষ্ঠ_জয়িতা সম্মাননায় ভূষিত হন। উপজেলা প্রশাসন করোনা পরিস্থিতির জন্য ক্রেস্ট ও সম্মাননা পত্র ২০২০-এ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করতে পারে নি কিন্তু যথাযথভাবে প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
গরিব প্রজারও জীবনে কিছু সম্মান ও স্বীকৃতির মুহূর্ত আসে। ফিরে যাই হুমায়ুন আজাদের সেই প্রিয় কবিতার কাছে―
“…আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম
থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের মা আজো টলমল করে।”
লেখক শোয়াইব জিবরান তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন―”আমার কেবলই দিরং হয়ে যায়।” হোক, তবু
তোমাকে অভিনন্দন―আম্মা।
লেখক: কবি ও গবেষক