নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
পদ্মা সেতুর এলাকা থেকে আচরণ ও বেশভূষা সন্দেহজনক হওয়ায় ১১ জনকে আটক করা হয়েছে গত ১৭ মাসে। জানা যায় তারা সবাই ভারতীয় নাগরিক।
লাগাতার ১৭ মাসে একের পর এক সন্দেহজনক ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের অভিযোগের জন্য গোয়েন্দা নজরদারি সহ বিভিন্ন নিরাপততা জোরদার করা হয়েছে।
গত কয়েক দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন প্রভাতী সংবাদকে এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
শরীয়তপুরের জাজিরা থানার পুলিশ জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড এলাকায় নিয়মিত টহলের সময় সন্দেহজনক আচরণ দেখে গত ১৭ মাসে ১১ ভারতীয়কে আটক করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের জাজিরা থানায় হস্তান্তর করা হয়। এই ১১ জনের মধ্যে চলতি বছরই আটক করা হয় ছয়জনকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে তাদের বেশভূষায় পাগল মনে হলেও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেশির ভাগকেই পাগল মনে হয়নি। কারণ তাদের বেশির ভাগই নিজের দেশ, বাড়ি, জেলা ও গ্রামের নাম পর্যন্ত বলতে পারছেন।
শুধু তা-ই নয়, তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের নামও বলেছেন। তবে এই ১১ জনের মধ্যে চারজনের কাছ থেকে কোনোভাবেই কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। এ কারণে এই চারজনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা’রা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আরও জানান, এই ১১ জনের অনেকেই হিন্দি ভাষার কথা বলেন। কয়েকজন হিন্দির মতো কথা বলেন, সেটা তাদের আঞ্চলিক ভাষাও হতে পারে।
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, ১১ ভারতীয় নাগরিককে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গেই রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনকে প্রাথমিকভাবে মানসিক ভারসম্যহীন মনে হওয়ায় তাদের পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
সেখানে চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারে ফেরত পাঠিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা এখন ভালো আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা প্রভাতী সংবাদকে বলেন, পার্শ্ববর্তী একটি দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা এসব সন্দেহভাজনের বেশভূষা, কথাবার্তা, আচার-আচরণে পাগলামির ভাব থাকলেও তাদের সবাইকে পাগল মনে হয়নি।
কারণ তাদের ছেঁড়া পোশাক, উশকোখুশকো চুল থাকলেও হাত ও পায়ের নখ পরিপাটি। ভারতের যেসব রাজ্য থেকে তারা আসার কথা বলেছেন, সেগুলোর কোনো কোনোটির দূরত্ব হাজার মাইলেরও বেশি।
এত দূর থেকে তারা কেন বাংলাদেশের শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতু এলাকায় এসেছেন, তদন্তসংশ্লিষ্টরা তাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম সন্দেহভাজন এক ভারতীয়কে আটক করা হয়। তার কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না। ব্যক্তিগত কোনো তথ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তিনি দেননি।
সর্বশেষ গত ২৫ জুন যে ভারতীয়কে আটক করা হয়, তিনি নিজেকে রুপসা রায় দিপক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পরিচয় যা জানা গেছে
আটক ১১ ভারতীয়র মধ্যে সাতজন তাদের নাম-ঠিকানা বলেছেন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তাদের সেই নাম উল্লেখ করেই মামলা হয়েছে। বাকি চারজনকে অজ্ঞাতপরিচয় দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তারা যে নাম-ঠিকানা দিয়েছেন:
রুপসা রায় দিপক: ২০২১ সালের ২৫ জুন জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় আটক হন তিনি। ভারতের গুজরাটের উম্বারিয়া জেলার জাগারিয়া থানার বিল্লা গ্রামের এই বাসিন্দার পিতার নাম খোরা রায়।
বিজলী কুমার রায়: তিনি আটক হন ২০২১ সালের ২৩ জুন জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাঝিরকান্দি এলাকা থেকে। ভারতের বিহারের এই বাসিন্দার পিতার নাম টুনা রায়।
বলদেভ হামরান: তাকে আটক করা হয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাওডোবা টোল প্লাজা এলাকা থেকে। তিনি উড়িষ্যার বাসিন্দা। তার পিতার নাম ডুবিলাল।
বীরু মণ্ডল: ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাওডোবায় বাংলা হাউসের প্রবেশপথ থেকে আটক হন তিনি। ভারতের ডান্ডিপুর এলাকার এই বাসিন্দার পিতার নাম বাগবান মণ্ডল।
সোনু সিং: তাকে আটক করা হয় ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাওডোবা এলাকা থেকে। বিহারের মালান্দা জেলার হারনাউদ থানার এই বাসিন্দার পিতার নাম বীর সিং তারাদেবী।
প্রমুথ কুমার মেরা: ২০২১ সালের ৪ মার্চ জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় আটক হন তিনি। মধ্যপ্রদেশের হোসনেয়াবাদ জেলার এই বাসিন্দার পিতার নাম লক্ষ্মণ সেন।
আরওয়ারী মদিমা চন্দনলতা: ২০২০ সালে ২৬ মে জাজিরার হাওলাদার মার্কেট থেকে আটক করা হয় দুই ভারতীয়কে। তাদের একজন আরওয়ারী মদিমা চন্দনলতা। তিনি ভারতের হরিপুরের আকিউরগঞ্জ বাজার এলাকার বাসিন্দা।
অজ্ঞাতপরিচয় চারজন: ২০২০ সালে ২৬ মে জাজিরার হাওলাদার মার্কেট থেকে আরওয়ারী মদিমা চন্দনলতার সঙ্গে অজ্ঞাতপরিচয় যে ভারতীয়কে আটক করা হয় তার পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
এর আগে একই মার্কেট থেকে ২০২০ সালের ৫ মার্চ আটক করা হয় আরেকজনকে, যার পরিচয়ও জানা যায়নি।
২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের টোল প্লাজা এলাকা থেকে একজনকে আটক করা হয়, যার পরিচয়ও জানা যায়নি।
২০১৯ সালে ১৪ ডিসেম্বর জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা থেকে একজনকে আটক করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি নাম-পরিচয় দেননি।
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এই ১১ জনকেই বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীর টহল দল পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড এলাকা থেকে আটক করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে।’
‘আমরা তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৯৫২ সালের কন্ট্রোল অফ এন্ট্রি অ্যাক্টের ৪ ধরায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করে আদালতে পাঠাই। তাদের সবাইকে আদালতের মাধ্যমে শরীয়তপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এদের কয়েকজন তাদের নাম প্রকাশ করেনি। তাই আমরা তাদের অজ্ঞাতনামা করেই আদালতে পাঠিয়েছি। এদের জন্য ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এখনও কেউ আমাদের কাছে আসেনি। এমনকি তাদের পরিবারের কোনো সদস্যও আসেনি।
‘কাগজপত্র ছাড়াই যেহেতু তারা বাংলাদেশে এসেছে, তাই তাদের ছয় মাস কারাগারেই থাকতে হবে। তারপর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হলে এক রকম, আর না হলে তাদের কারাগারেই থাকতে হবে।’
ভাষা বোঝা যায় না
শরীয়তপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেল সুপার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মনদীপ ঘরাই বলেন, ভারতীয় বন্দিদের মধ্যে নতুন আসা দুজনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। সোমবার তাদের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এই দুইজন বাদে বাকি সবাই সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেই থাকে। বন্দিদের মধ্যে একজন নারী রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘চারজনকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারেই রাখা হয়েছে। কারাবন্দি ভারতীয় মহিলা চিল্লাপাল্লা করে। তার ভাষাও আমরা বুঝি না। কারাবন্দি সবাই স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। তারা আমাদের কথাও বোঝে না।’
প্রভাতী সংবাদের এক প্রশ্নের জবাবে মনদীপ ঘরাই বলেন, ‘আমরা নিজেরা বলতে পারি না তারা পাগল। তবে চারজনকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা শেষে তারা পাঠিয়ে দিয়েছে। আনার পর তারা এখন ভালো আছে।’