More

    আ’লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শ্রদ্ধাঞ্জলি

    নিজস্ব প্রতিবেদক

    আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বুধবার ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় ছাত্রলীগের কয়েক শত নেতাকর্মী।

    এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ সহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

    এসময় সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় নেতাকর্মীরা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শুভ শুভ শুভ দিন, আওয়ামী লীগের জন্মদিন, নেতা মোদের শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। এ সময় সেখানে তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

    আরও পড়ুন: আ’লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন

    শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ছাত্রলীগ সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-স্বাধীনতা এই তিনটি শব্দ অমলিন, অবিনশ্বর, অবিনাশী। ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ। সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হার না মানা নেতৃত্ব এবং নেতাকর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও অঙ্গীকারদীপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসবিদিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের লাল-সবুজের স্বাধীনতা।’

    আরও পড়ুন: ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্সে কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা

    তিনি আরো বলেন, ‘দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও প্রাসাদসম ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলটি আজ এ দেশের গণমানুষের ভাব-ভাবনার ধারক-বাহক, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে এবং গণতন্ত্রের মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবে।’

    আরও পড়ুন:  “ইউরোপে মুসলিম নেই ইসলাম আছে, বাংলাদেশে মুসলিম আছে ইসলাম নেই”

    সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। ১৯৪৯ সালের এই দিনে জন্মলাভের পর থেকেই এই জনপদে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির সমন্বয় ও রাজনীতিতে সততা ও সম্প্রীতির আদর্শকে দলটি সর্বদা ধারণ করে এগিয়ে চলছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে রেখেছে ঐতিহাসিক অবদান। আর এসব আন্দোলনের পুরোধা ও একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

    তিনি আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হাজারো লড়াই, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা অতিক্রম করে আজ এই পর্যায়ে এসেছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবে।’

    আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা

    ১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ ভাগ হলো। নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে মনোনিবেশ করলেন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ।

    তারই ধারাবাহিকতায় ২৩ জুন, ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় কমিটি। কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডনে গঠিত হয় নতুন এ দলটি।

    শেখ মুজিব জেলে থাকা অবস্থাতেই তাঁর নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে এই সংগঠনের প্রাতিষ্ঠাতা যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

    এরপর সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে। তিনি ছাত্রলীগের নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে দেন। এরপর থেকে নিজে পুরোদমে মন দেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রসারে।

    বাংলা ভাষার আন্দোলন ও শেখ মুজিব

    মাতৃভাষার অধিকারের জন্য দেশজুড়ে যখন গণজাগরণ তুঙ্গে, এমন সময় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের ভাষণে বলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি।

    ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদী মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। পাকিস্তানি জান্তাদের গুলিতে প্রাণ হারান অনেকে। রঞ্জিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ।

    এই সময় শেখ মুজিবকে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে হাসপাতালে থাকার সুবাদে তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। এসময় ছাত্রনেতাদের ডেকে নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরামর্শ দেন এবং আওয়ামী লীগ নেতাদেরও এ ব্যাপারে অবহিত করেন।

    তার নির্দেশেই এই সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয় ছাত্রলীগের কাজী গোলাম মাহবুবকে। শেখ মুজিবের তৎপরতা বুঝতে পেরে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে স্থানাস্তরিত করা হয় তাকে। এর আগেই, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কঠোর আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থণ দেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে অনশন শুরু করেন তিনি।

    তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সরকার। ১৯৫২ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার ফেরেন তিনি। আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তখনো বন্দি।

    তাই দলের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন শেখ মুজিব। সভায় তাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

    যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের জয়জয়কার

    দীর্ঘদিন কারাজীবন শেষে, ১৯৫৩ সালের দিকে আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তি পেতে থাকেন। সেই বছরই, ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল ডাকা হয়।

    মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর একপর্যায়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে আওয়ামী লীগে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান শেখ মুজিব।

    মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চাঁদপুরের এক জনসভায় তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানান।

    কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নিজেই কৃষক-শ্রমিক পার্টি গঠন করেন। এর আগে ১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার কৃষকপ্রজা পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

    তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই প্রথম তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন এবং নিজের দল নিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেন। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সৃষ্টি হলো যুক্তফ্রন্ট।

    এর সঙ্গে থাকা অন্য দলগুলো হলো গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলাম ও ফেলাফতে রব্বানী। ১৯৫৪ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় যুক্তফ্রন্ট।

    যুক্তফ্রন্টের সভাপতি মনোনীত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীন সোহরাওয়ার্দী। বাংলার প্রতিটি প্রান্তে নিরলস প্রচারণা চালাতে থাকেন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

    এই প্রাদেশিক নির্বাচনে কট্টর ধর্মীয় প্রচারণা উপেক্ষা করে মানবিক অধিকারের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট দেয় জনগণ। ফলে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৮টি আসনে জয়লাভ করে এই জোট। আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৪৩টি আসন।

    আওয়ামী লীগের সরকার

    মুসলিম লীগের ধর্মের খোলস উন্মোচন করে, আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কারণে মাত্র দুই মাসের কম সময় ব্যবধানে, ১৯৫৪ সালের ৩১ মে, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয়।

    একই সঙ্গে ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্তান আইনপরিষদের ৩৫ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায় এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।

    এদিকে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি বাংলার মানুষের গণরায়ের ওপর ভিত্তির করে, ১৯৫৫ সালের ২২-২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়।

    দেশের সর্বসাধারণের সবার জন্য এই দলের দুয়ার খুলের দিতে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের উদ্যোগেই এই বাস্তবায়িত হয়। প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে সদস্য হিসেবে জায়গা পান তাজউদ্দীন আহমদ।

    এরপর ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। মুখ্যমন্ত্রী হন দলের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান। এই মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবকে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ ও গ্রামীণ সহায়তাবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

    কিন্তু দলের কাজে সময় দেওয়ার জন্য মে মাসের শেষে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগেক শক্তিশালী করার কাজে নিমগ্ন হয়ে যান তিনি।

    সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন

    ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিরোধের জেরে ১৯৫৭ সালে ১৩ ও ১৪ জুন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন শেখ মুজিবুর রহমান।

    কাউন্সিলররা বিপুল ভোটে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি অনুমোদন করেন। এদিকে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিভেদের কারণে আওয়ামী লীগ ছেড়ে নতুন দল গড়েন ভাসানী। ভাসানী। ফলে দলের এই কাউন্সিল থেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে।

    এদিকে ১৩ মাস সরকার পরিচালনার পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন হয় এবং ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেন সোহরাওয়ার্দী।

    এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সোহরাওয়ার্দীর মতো গণতন্ত্রকামী আওয়ামী লীগ নেতা প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকলে এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে, এই আশঙ্কা থেকে ইস্কান্দার মির্জা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

    পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক আইন জারি করেন তিনি। ১২ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবকে। ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল নেন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। দেশে নিষিদ্ধ করা হয় রাজনীতি। গ্রেফতার এড়াতে সিনিয়র নেতারা অবসরের ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ জীবন বেছে নেন।

    কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় আইয়ুব খান কর্তৃক তথাকথিত মৌলিক সংবিধানকে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

    ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তিনি। তার সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিচল সমমনা রাজনৈতিক নেতারাসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এসময়। রাজনীতির স্থবির সময়ে মুজিবের এই গতিশীল যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে অনেকে মুজিব নেটওয়ার্ক বলে অভিহিত করেন।

    ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, একক নেতৃত্বে দলকে পুনর্জীবন প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বর্ষীয়ান নেতারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামরিক সরকারের অধীনে এই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর বিপক্ষে ছিলেন।

    কিন্তু শেখ মুজিবের সাহসী উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব জেলায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়।

    মার্চের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে বয়সে জ্যেষ্ঠতার কারণে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে, নিজেই সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকে যান শেখ মুজিবুর রহমান।

    কয়েক বছরের রাজনৈতিক স্থবিরতা ভেঙে নতুন করে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মের উদ্যোক্তা ও প্রবাদ পুরুষ তিনি। তার হাত ধরে এক নতুন আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু হয়।

    ছয় দফার এক দাবি ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিব

    ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান লাহোরে বিরোধী দলীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন।

    কিন্তু তা গৃহীত হয় না। ফলে ঢাকায় ফিরে, ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে তিনি এটি পাস করিয়ে নেন দলের কাছ থেকে।

    ১৮ ও ১৯ মার্চের কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়।

    ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে গণপ্রচারণা শুরু হয় ছয় দফার পক্ষে।

    কিন্তু পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও রাজনীতিকরা অস্ত্রের ভাষায় এই গণজাগরণ মোকাবিলার চেষ্টা করে। এর প্রতিবাদে ৭ জুন হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। বিপরীতে সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তানিরা।

    কিন্তু ছাত্র-জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরাও রাজপথে নেমে আসে ছয় দফার সমর্থনে। জান্তাদের গুলিতে প্রাণ হারায় ১১ জন। এরপর গণগ্রেফতার শুরু হয়। একের পর এক আটক হতে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

    গ্রাম-গ্রামান্তের মানুষ পর্যন্ত সোচ্চার হয়ে ওঠে ছয় দফার পক্ষে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা। তাই বঙ্গবন্ধু যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।

    মাত্র দেড় মাসে বিভিন্ন জেলায় ৩২টি জনসভা করেন শেখ মুজিব। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘমেয়াদে জেলে রাখা হয়।

    মুক্তির পথ তৈরির জন্য নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন

    ছয় দফা ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতিতে, গ্রেফতার এড়াতে আওয়ামী লীগের অনেকেসহ অন্যান্য দলের নেতারা একটা রাজনৈতিক কর্মসূচিহীন জোট (পিডিএম) গঠন করেন।

    এমনকি তারা আট দফা ঘোষণা করে ছয় দফার জাগরণকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালান। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকা হয় এবং কয়েকজন বাদে বাকি সবাই এই জোটে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেন।

    এরপর শেখ মুজিবুর রহমানকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আবুল হাসনাত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়।

    আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক এই ছয় দফার পরপরই বাংলার রাজনীতির গতিপথ বদলে যায়। তৎকালীন অন্যান্য বর্ষীয়ান নেতারা বাংলার সাধারণ মানুষের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হন।

    শুধু শেখ মুজিবের ছয় দফার বিরোধিতা করায়, ভারতবর্ষের বৃহত্তর পরিসরে জননেতা হয়ে ওঠা অনেক পুরনো নেতার ক্যারিশমাও জনরোষের স্রোতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। বাঙালির মনন ও মগজের মণিকোঠায় মহান নেতা হিসেবে একচ্ছত্র জায়গা দখল করে নেন শেখ মুজিবুর রহমান।

    ছয় দফা হয়ে ওঠে বাঙালির প্রাণ এবং শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির একমাত্র কণ্ঠস্বর। আর আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার অমিয় স্বাদ এনে দেওয়ার মতো একটি মাত্র দল। কারণ ছয় দফায় ছয়টি দাবি থাকলেও মূল দাবি আসলে ছিল একটি, আর সেটি হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি।

    এই ছয় দফা ঘোষণার পর পূর্ব-পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।

    ছয় দফার প্রথম দুই দফায় রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও পরের চার দফায় অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হলেও, এটি আসলে ছিল বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত দাবি। যার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ।

    আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণঅভ্যুত্থান

    ছয় দফার গণজাগরণে ভীত হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। মূলত বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসী নেতৃত্ব ও গগনচুম্বি জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে, তাকে জেলে ঢোকায় পাকিস্তানের সামরিক সরকার।

    কিন্তু জাতীয় মুক্তির যে বীজমন্ত্র তিনি রোপণ করেছিলেন, তা ততদিনে শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে গেছে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তাই বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপুস্থিতি কখনোই তার আদর্শিক মতাদর্শ বিনির্মাণে বাধা হতে পারেনি।

    বঙ্গবন্ধু জেলে যাওয়ার পরও আন্দোলন চলতে থাকে। ছয় দফাকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে পুরো জাতি।

    এরকম এক পরিস্থিতিতে, ১৯৬৮ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নামে দায়ের করা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ নামের একটি মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)।

    জেলে থাকা অবস্থাতেই, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, নতুন করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। অভিযোগে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন’।

    সোজা কথায় বলতে গেলে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন এবং পরিচালনার জন্য বাঙালি সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে ধারাবাহিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন, সেটাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন ব্যক্তির নামে এই মামলা দায়ের করে সামরিক সরকার।

    এসময় দেশজুড়ে মানুষ স্লোগান দিতে থাকে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে একাকার হয়ে যেতে থাকে বাঙালির মানসপটে।

    পরবর্তীতে প্রবল জনরোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ও স্বঘোষিত ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান। সেদিনই কারাগার থেকে মুক্তি পান বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিমূর্ত প্রতীকে পরিণত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান।

    পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাকে। একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র বঙ্গভূমি তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ নেতা মেনে প্রকাশ্যে উল্লাস করে সাত কোটি বাঙালি।

    এই গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয় এবং ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। অন্যদিকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একচ্ছত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

    ১৯৭০-এর নির্বাচন: আওয়ামী লীগের বিজয় ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপ

    জেল থেকে বের হয়ে এসে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন বঙ্গবন্ধু। সাত কোটি জনতা কণ্ঠ মেলায় তার সঙ্গে। প্রচণ্ড গণদাবির মুখে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি জান্তারা।

    পাকিস্তানিদের শোষণে শ্মশানে পরিণত হওয়া বাংলাকে আবার সোনার বাংলায় পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন বঙ্গবন্ধু। ছয় দফার বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখান। ফলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একচেটিয়াভাবে ভোট দেয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে।

    যার ফলে, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে সরাসরি ভোটে জিতে পুরো পাকিস্তানের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে সরাসরি ভোটে ২৮৮টি আসন লাভ করে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একমাত্র আস্থার জায়গার পরিণত হয় আওয়ামী লীগ।

    ১৯৭০ সালে জাতীয় নিরর্বাচনে সংরক্ষিত ৭ আসনসহ উভয় পাকিস্তান মিলে ৩১৩ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের মোট জয় করা আসন হয় ১৬৭টি। আবার প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩১০ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত ১০ আসনসহ আওয়ামী লীগের মোট আসন হয় ২৯৮।

    বাংলার জনগণের কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে দীর্ঘ দুই যুগের আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক পথে এগুতে থাকেন আওয়ামী লীগ প্রধান প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান।

    কিন্তু পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে জনগণের রায়কে প্রত্যাখান করার পাঁয়তারা করতে থাকে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কৌশলে দেশবাসীকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু।

    ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন

    পাকিস্তানিদের যেকোনো দূরভিসন্ধি মোকাবিলার জন্য, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ করান বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত থাকার শপথ নেন।

    ইতোমধ্যে জাতির ঘোষণা হিসেবে ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে, তিনি হয়ে দাঁড়ান বাঙালির বৈধ সুপ্রিম কমান্ড। কিন্তু জুলফিকার ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

    সেদিনই বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

    তিনি বলেন, ‘আজ থেকে বাংলার সচিবালয়, কোর্ট-কাচারি, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবকিছু অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে।… যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো।… দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।’

    বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি অঘোষিত কিন্তু বিকল্প সরকার পরিচালিত হতে শুরু করে বাংলাদেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ব্যবহার হতে থাকে বিকল্প সরকার প্রধানের বাসভবন হিসেবে। শুধু সামরিক ছাউনিগুলো ছাড়া বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের কোনো আদেশ মানা হলো না।

    সব স্থান থেকে নামিয়ে ফেলা হয় পাকিস্তানের পতাকা। উড়তে থাকে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের নিশান। পুরো দেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেন আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম পরিষদ।

    আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা

    এরকম একটি পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চের কাল রাতে ঘুমন্তু বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তারা। ফলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এর পরপরই গ্রেফতার করা হয় তাকে। নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন জেলে।

    কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আপামর বাঙালি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের মুক্তাঙ্গনে শপথ নেন তারা।

    এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব নেন। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দিয়ে গঠন করা হয় স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে রণাঙ্গন।

    দীর্ঘ ৯ মাস রক্ষাক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন তিনি। ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

    এরপর প্রথমেই তিনি মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ, ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিজেদের সামর্থ্য দিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধু।

    জাতীয় চার নীতি ও সোনার বাংলা পুনর্গঠনের অসমাপ্ত যুদ্ধ

    আওয়ামী লীগের হাত ধরে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে বাঙালি জাতি। অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। দেশ পুনর্গঠনের মন দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।

    সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়ে চলতে থাকে অবকাঠামো নির্মাণ। দীর্ঘমেয়াদে সুন্দর জাতি গড়ার লক্ষ্যে প্রণয়ন করেন বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা। এরমধ্যেই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা হয় সংবিধান।

    জাতীয় ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে ঘোষণা করা হয় জাতীয় চার নীতি হিসেবে। প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি ও শিল্পনির্ভর সমাজকাঠামো গড়ার দিকে এগিয়ে যান বঙ্গবন্ধু।

    ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। পরের বছরের শুরুতেই, একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে ধাবিত করার দিকে মনোনিবেশ করেন তিনি।

    মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অনেক অভ্যন্তরীণ দুর্বত্তায়ন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে প্রায় গুছিয়ে আনেন তিনি।

    কিন্তু এরমধ্যেই বাংলার আকাশে নামে দুর্ভোগের ঘনঘাটা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

    বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও আওয়ামী লীগের ওপর দমনপীড়ন

    বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, স্বৈরশাসকদের হিংস্র থাবায় বিক্ষত হতে থাকে সোনার বাংলা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। ১৫ আগস্টের কালরাতে বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই দুহিতা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। স্বৈর

    শাসকরা যখন আওয়ামী লীগ ভেঙে দেওয়ার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই নেতাকর্মীদের আহ্বানে দলের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে দল ও দেশকে বাঁচাতে দেশে ফেরেন তিনি।

    স্বৈরাচারদের দৌরাত্ম্য ও স্বাধীনতাবিরোধীদের আগ্রাসনের কারণে, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধই ছিল এই দেশে। ফলে এসব প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়ানো মোটেও সহজ ছিলো না আওয়ামী লীগের জন্য। কিন্তু গণমানুষ চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন।

    তাই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। এরপর দলের প্রধান হিসেবে ১৯ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। স্বৈরাচারের বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধী দুর্বৃত্তরা এবার তাকেও হত্যার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে।

    সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, প্রতিদিন জীবন হাতে নিয়ে টানা ৯ বছর রাজপথে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

    এই ৯ বছরের মধ্যে প্রত্যেক বছরেই আটক ও বন্দি করা হয় শেখ হাসিনাকে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দুবার গৃহবন্দি করা হয়।

    ১৯৮৫ সালের মার্চে তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে তাকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়।

    ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারো গ্রেফতার ও গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৯০ সালে নভেম্বরে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়।

    এছাড়াও অজস্রবার রাষ্ট্রীয় মদতে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে তাকে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এসময় কয়েকজন আওয়ামী রীগ নেতা-কর্মী নিহত হন।

    জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শেখ হাসিনাকেসহ তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে।

    এসময় ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রাণ হারান। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।

    ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির লোকরা।

    শেখ হাসিনার হাত ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

    শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এসময় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ।

    ফলে ফিরে আসে সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর দমন-পীড়ন থেমে থাকে না। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়।

    ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হয়। তবুও মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে কখনও পিছপা হননি শেখ হাসিনা।

    পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে বিএনপির একটি সাজানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হন।

    এবং জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২১ বছর থমকে থাকার পর আবার চলতে শুরু হয় বাংলাদেশ।

    প্রধানমন্ত্রী হয়েই, দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থাকা গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত করেন, ফলে কয়েক দশক ধরে চলমান চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমিত হয়।

    ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় আওয়ামী লীগ সরকার দুই কোটি বন্যাদুর্গত মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য প্রদান করে বিশ্বের বুকে দুর্যোগ মোকাবিলার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো খাদ্যস্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন তিনি।

    কেটে যায় তলা বিহীন ঝুড়ির অপবাদ। এরপর সরকারের মেয়াদ শেষে সুন্দরভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা।

    কিন্তু ২০০০ সালে এক জনসভাকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় কোটালিপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়।

    ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের জনসভায় এক ডজনের বেশি গ্রেনেড হামলা চালানো হয় তার ওপর।

    তাকে বাঁচাতে মানববুহ্য রচনা করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। বিএনপি-জামায়াতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো এই হামলায় প্রাণ হারান ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। আহত হন কমপক্ষে ৩০০ জন।

    ১/১১ এর কালো ছায়া কাটিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অভিযাত্রা

    বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষ। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, নিয়ম অনুযায়ী একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তাদের।

    কিন্তু লুটপাট অব্যাহত রাখার জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির এক আত্মীয়কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসানোর পাঁয়তারা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

    এ ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু খালেদা জিয়ার পরামর্শে, ২৯ অক্টোবর রাতে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফলে সৃষ্টি হয় সাংবিধানিক সংকট।

    ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য। মাইনাস টু ফর্মুলার নামে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়।

    ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। মিথ্যা মামলায় ২০০৭ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর, একের পর এক মোট ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। ২৪ জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।

    জেলে বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়। তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত কান ও চোখ চিকিৎসার অভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

    তাকে স্লো-পয়জনিং করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তার অসুস্থতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যায়। অবশেষে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়।

    সেখানকার চিকিৎসকরা টানা ২০ দিন চিকিৎসার পর তাকে আপাত স্বাভাবিক করে তোলেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

    এদিকে বিএনপি-জামায়াত চক্র এবং কতিপয় সামরিক সদস্য নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আটক ও হয়রানি শুরু হয়।

    ২০০৮ সালের ২৩ মে, আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের ৭২টি সাংগঠনিক শাখার তৃণমূল নেতারা শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং তাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দেশজুড়ে চলমান আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন।

    ২৭ ও ২৮ মে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্ত হয়- শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেফতার। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়।

    কিন্ত তবুও শেখ হাসিনার পক্ষে গণজোয়ার থামানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের সামনে কুচক্রীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন, বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা।

    জেল থেকে বের হয়ে, গণমানুষের ভাগ্য বদলের জন্য ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি।

    উন্নত বিশ্বের দিকে ধাবমান প্রিয় সোনার বাংলা

    ৫০ বছরের বাংলাদেশে, অনেক ঝড়-ঝাপটা ও দুঃসময় কাটিয়ে সাড়ে ২৩ বছর দেশশাসন করার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সাড়ে ২৩ বছর আওয়ামী আমলের মধ্যে, ২০ বছরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

    তার অদম্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই দেশ থেকে দূর হয়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র। লোড শেডিংয়ের অন্ধকার শেষে প্রত্যন্ত গ্রামের এখন পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার মূল সড়কগুলো সব চার লেনে উন্নীত করার মাধ্যমে বৃদ্ধি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও যোগাযোগ।

    মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে, ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে, টানা তৃতীয় বার ও মোট চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

    তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের তালিকায় নাম লেখানোর স্বপ্নময় পথ অতিক্রম করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্নের গণ্ডি ছড়িয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বীরের জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান ফিরে পেয়েছে বাঙালি জাতি।

    গত এক যুগে দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার, আওয়ামী লীগ সরকার তা চারগুণ বৃদ্ধি করেছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার।

    বাংলাদেশি মুদ্রায় তা বছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়।

    এমনকি করোনা মহামারি মোকাবিলা করেও ঠিক রাখা সম্ভব হয়েছে দেশের অর্থনীতি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০২১ সালের জুন মাসেও তা বহাল আছে।

    ধর্মের সঠিক শিক্ষা ও প্রসারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ৫০০ মডেল মসজিদ। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে ছয় মাস পর্যন্ত। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিরাপত্তা বেড়েছে বয়স্ক মানুষ, নারী ও শিশুদের। মানবিকতারে হাত ধরে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

    এদিকে, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি, দেশের টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে ওঠার কারণে বিশ্বব্যাপী নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

    এক যুগের চলমান সুশাসনে দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার পর গত তিন যুগের অধিক সময়ে যা সম্ভব হয়নি, আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ এক যুগে তাই সম্ভব হয়ে দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

    নব্বইয়ের দশকে যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৩ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পেরেছিল, সেখানে গত এক দশকে ৫ কোটির বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে।

    বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে এবং হতদরিদ্রের হার ২৪ দশমিক ২ থেকে নেমে কমে ১০ শতাংশের কমে এসেছে।

    সবার জন্য বিনামূল্যে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব স্থান থেকে বিনামূল্যে ৩০ ধরণের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

    ডিজিটালাইজেশনের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বইতে শুরু করেছে পরিবর্তনের হাওয়া। প্রতিনিয়ত পালটে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেহারা। খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে দেশ। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭১ এর ওপরে উঠেছে (নারীদের ৭৫ বছর ও পুরুষদের ৭১ বছর)।

    এছাড়াও জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে লিঙ্গ সমতা, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষপণ, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে।

    নিজস্ব অর্থায়নে নান্দনিক পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎকন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।

    বিশ্বের বিস্ময়….

    বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারিতে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মারা যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে, মহামারি মোকাবিলায় দিনরাত জনসেবায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

    ফলে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশের এই ভাইরাসের গণসংক্রমণ ঘটেনি। এমনকি গণমানুষের পাশে সরকার সক্রিয় থাকায় কর্মহীন মানুষদেরও না খেয়ে থাকতে হয়নি। অসহায়দের ঘরে ঘরে খাদ্য ও আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।

    এমনকি জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য দলের নির্দেশ মেনে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থাকার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে দলের অনেক নেতাকর্মীকে। নিজেদের জীবন বাজি রেখে আওয়ামী লীগ সবসময় গণমানুষের পাশে ছিল, এই করোনাকালে তা আবারও প্রাণ দিয়েই প্রমাণ করেছে।

    আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের ইতিহাস, দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত থেকে আত্মদানের ইতিহাস। সুখে-দুঃখে- দুর্যোগে দুর্বিপাকে- সর্বদা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে- সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়াই আওয়ামী লীগের দৃপ্ত প্রত্যয়।

    আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের পথচলার সোনালি অর্জনের নাম বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্র ও জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগের নিরলস লড়াই চলমান রয়েছে।

    সংগ্রাম ও স্নেহ-ভালোবাসায় একাকার হয়ে, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ- এক অপরের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছে। বাঙালি জাতি জয় বাংলা বলে প্রতিনিয়ত আগে বাড়বে।

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img