More

    একটু শান্তির খোঁজে

    অনেক স্বপ্ন ছিলো বাবার । তিনি মনে করতেন মেয়ে একদিন ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হবে । প্রত্যেক বাবারই তাঁর রাজকন্যা নিয়ে এমন স্বপ্ন থাকে । কিন্তু বিধির লীলা খেলা বোঝা বড় দায় ! ১২ বছর বয়সেই মনিকা বাবাকে হারালো চিরতরের জন্য।

    রোকশানা লিপি:

    যৌথ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠতে লাগলো মনিকা,বৃদ্ধ বাবা মা দাদী আর ভাই ভাবীদের সাথে আরো আছে বোন ভাইপো ভাইঝি।

    সব মিলিয়ে পরিবারের সদস্য ২১ জন। ভাইয়েরা চাকরি করেন । তাঁরা তাঁদের কর্মস্থলে থাকেন । ভাবী ছেলেমেয়েরা বাড়িতেই থাকে।

    ২/১ সপ্তাহান্তে তাঁরা বাড়িতে আসে। তখন একরকম ঈদ ঈদ ভাব লাগতো মনিকার।

    বাবা রিটায়ার্ড ,মা অনেক পরিশ্রমী । বাড়ির বউদের সাথে নিয়ে সারাদিন কাজ করেও মনে হতো, কাজ শেষ হয়নি ।

    এভাবেই মনিকা বেড়ে উঠতে থাকে । বৃদ্ধা মা কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতেন, এর মাঝেই মনিকা কে পড়তে বসার তাগিদ দিতেন ।

    আধুনিক মায়েদের মতো পাশে বই নিয়ে বসার সুযোগ পাননি। মনিকা অতি মেধাবী না হলেও চলনসই ছিলো । তবে বাবার চোখে মনিকা ছিলো খুবই ব্রিলিয়ান্ট।

    অনেক স্বপ্ন ছিলো বাবার । তিনি মনে করতেন মেয়ে একদিন ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হবে । প্রত্যেক বাবারই তাঁর রাজকন্যা নিয়ে এমন স্বপ্ন থাকে ।

    কিন্তু বিধির লীলা খেলা বোঝা বড় দায় ! ১২ বছর বয়সেই মনিকা বাবাকে হারালো চিরতরের জন্য।

    সংসার জীবনে খাওয়া পরাটাই সব না । মনিকা তার বন্ধুদের দেখতো ,বাবার সাথে ঘনিষ্ঠতা, দেখতো কীভাবে সন্তানের চাহিদা পূরণ এমন কী তাদের খুনসুটি। চোখের জল আটকে রাখতে পারতো না ।

    স্কুলে বন্ধুরা বাদাম চকলেট খাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে আসতো । আর মনিকা ভয়ে ভাইদের কাছে টাকা চাওয়ার সাহসই পেতো না ।

    এভাবে বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি পিকনিক জন্মদিন কতো আড্ডা জলাঞ্জলি দিয়েছে মনিকা । ভেবেছিলো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

    বৃদ্ধা মা মাধ্যমিক যেতে না যেতেই বিয়ে দেয়ার জন্য উদগ্রীব। বাবা নেই,মা বিয়েটা দেখে যেতে চাই । শুরু হলো পাত্র দেখা ।

    অনেক দেখাদেখির পর পাত্রপক্ষ এলোও । তবে পাত্রের মা বলেছিলেন,”যে মেয়ের বাবা থাকেনা সেই বাড়িতে জামাই আদর হয় না”।

    কী বিচিত্র আমাদের সমাজ । অবশেষে বেশ আয়োজনের মধ্যেই মনিকার বিয়ে হয়ে গেলো ।

    নতুন জীবন শুরু করলো মনিকা । যে মেয়ে বাবার বাড়ি কোন কাজ করেনি সেই মেয়ে শ্বশুরবাড়ির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি।

    একহাতেই যৌথ পরিবারটি সামলে যাচ্ছিলো । তবে এসবের মাঝেও সময় পেলে বইটা নিয়ে বসতো । যদিও এই নিয়ে অনেক কথা শুনতে হতো ! অনেকেই বলতো,”পড়ে কী ব্যারিষ্টার হবে, কতো দেখলাম”!

    শেষ অবধি একরকম যুদ্ধ করেই পড়া শেষ করলো মনিকা।দিন যায় মাস যায় বছর যায়,এরই মাঝে মনিকার ঘর আলো করে আসে এক ফুটফুটে কইন্যা । মনিকা তার মেয়ের চোখে নিজের ফেলে আসা স্বপ্ন দেখতে পাই ।

    কিন্তু বিধি বাম, মেয়ের বয়স যখন ৮ । হঠাৎ ই খবর এলো মনিকার স্বামীর রোড এ্যাকসিডেন্ট এর। দৌড়ে ছুটে গেলো হাসপাতালে ।

    রক্তমাখা দেহটা অসাড়ে পড়ে আছে ট্রেসারের উপর । মনে হলো কিছু একটা বলতে চাই মনিকাকে। কিন্তু না ততক্ষণে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে।

    মনিকা তো ১২ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলো, কিন্তু তার মেয়ে বাবাহারা হলো মাত্র ৮ বছর বয়সে । সবই ঐ একজনের লীলা খেলা,বোঝা বড় দায় !!

    এবার শুরু হলো মনিকার সংগ্রামী জীবন। সংসারে এতো পরিশ্রম করার পরও, বিনিময়ে পায় শুধুই লাঞ্ছনা। সে শুধু ভাবতো এই লোহার শেকল ভেঙে তাকে বের হতে হবে ।

    নইলে তার মেয়ের জীবনটা অনিশ্চিত । পেটে কিছু বিদ্যা তো তার আছে ! তবে সে জানে, চাকরির বাজারও মন্দা । এসব জেনেও সে চেষ্টা শুরু করলো চাকরির।

    অবশেষে তার এক নিকট আত্মীয়ের সহায়তায় এনজিও তে কোন রকম পেটভাতা বরাবর একটা কাজ পেলো ।

    মনিকার ভাইয়েরা সমাজে বেশ প্রভাবশালী। বোনের তেমন কোনো খোঁজ রাখেন না ।বোনদের বিয়ে হয়ে গেলে বুঝি ভাইয়েরা এমনই হয়।

    মনিকার সংসার এখন, মা আর মেয়ের সংসার । সাংসারিক ঝামেলা তেমন নেই বললেই চলে তবুও এতোটুকু ফুরসত পায় না সে।সংসারের কাজ শেষ করে ছুটতে হয় বাড়ি বাড়ি।

    লোন প্রকল্পের টাকা (কিস্তি) আদায় করতে। অনেকেই মনিকাকে কিস্তি আপা বলেও ডাকে।

    এরই মাঝে বাড়িতে ঘটকের আনাগোনাও চলে। আবার অতি উৎসাহী মানুষেরও অভাব নেই সমাজে। এদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলা সমাজে খুব দুষ্কর।

    মনিকার দৃঢ় প্রত্যয়, সে আর দ্বিতীয় সংসারে যাবে না । মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করবে।

    মনিষা (মনিকার মেয়ে) বড় হতে লাগলো । মায়ের এতটুকু সুখের জন্য সে সবসময় ব্যাতিব্যস্ত। অত্যন্ত মেধাবী হয়েছে মেয়েটি ।

    প্রতিজ্ঞা তার একটিই, কীভাবে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে । মনিষা তার পড়ালেখার খরচ নিজে টিউশনি করেই চালিয়ে নেয় ।

    যখন মনিষা মেডিকেল কলেজ এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলো, তখন মনিকাকে দেখে মনে হয়েছিল সে আজ আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে ।

    খুশিতে পাড়াঘরে মিষ্টি বিতরণ করলো, কোন ঘর যেনো বাদ না পড়ে সেদিকে নজর ছিলো তীক্ষ্ণ ।

    এবার ভালো ভালো পরিবার থেকে মনীষার বিয়ে আসা শুরু হলো, যেহেতু মেয়ে ডাক্তার। মেয়ের একটিই ইচ্ছা সে ডাক্তারী পাশ করে তবেই বিয়ে করবে।

    মেয়ের ইচ্ছেই মায়ের ইচ্ছে। মনীষা পড়ালেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত সেই সাথে তার টিউশনি। এদিকে তার মায়ের শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে, সেটা কখনোই মেয়ের কাছে প্রকাশ করে না । শুধু একটাই চিন্তা কখন মেয়েকে ভালো পাত্রে পাত্রস্থ করবে।

    হঠাৎ একদিন বাড়ি আসার পথে মাথা ঘুরে মনিকা পড়ে যায় রাস্তায়। সবাই ধরাধরি করে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়।

    কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা শহরে পাঠায়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শেষে দেখা গেল মনিকা ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত।

    একটু সুখের খোঁজ সে আর পেলো না কোনদিন। জীবন সংগ্রামে সে আজ পরাজিত সৈনিক । এরা শুধু যুদ্ধ করতেই জানে । যুদ্ধের ফল ভোগ করে যেতে পারে না।

    লেখক: কবি, কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষিকা

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img