প্রভাতী বার্তাকক্ষঃ
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যরা চলে যাওয়ায় তালেবান সৈন্যরা মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন যে তাদের ভয়ে আফগান সেনারা পালাচ্ছে।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মার্কিন জোটের সঙ্গে আফগান নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরাও ওই অঞ্চল থেকে পালিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি।
রোববার স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, তালেবানের অভিযানের মুখে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশি তাজিকিস্তানে পালিয়েছেন।
রোববার এক বিবৃতিতে তাজিকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি বলেছে, ‘তালেবানের যোদ্ধারা সীমান্ত অভিমুখে এগিয়ে আসায় আফগানিস্তানের বাদাখাশান প্রদেশের সীমান্ত পেরিয়ে আফগান সামরিক বাহিনীর ৩ শতাধিক সদস্য তাজিকিস্তানে ঢুকেছে। শনিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আফগান সৈন্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে।’
‘মানবতাবাদ এবং ভালো প্রতিবেশী নীতির আলোকে তাজিক কর্তৃপক্ষ পশ্চাদপসরণকারী আফগান সরকারি বাহিনীর সদস্যদের তাজিকিস্তানে প্রবেশ করতে দিয়েছে’— বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানে ‘চিরকালীন যুদ্ধ’ অবসানের ঘোষণা দেওয়ার পর নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে শুরু করে তালেবান।
এর মধ্যে তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো— দেশটির উত্তরাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া; যে এলাকাটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল।
এছাড়া বিদেশি সামরিক বাহিনীর সমর্থনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে দেশটি ক্রমবর্ধমান হারে আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তালেবান যোদ্ধারা অনেক প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য চারদিকে অবস্থান নিয়েছে। বর্তমানে তালেবান দেশটির ৪২১টি জেলার প্রায় এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো গত এপ্রিলে জানিয়েছিল, নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার ২০তম বার্ষিকীর দিনে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর তারা আফগানিস্তান থেকে ১০ হাজার বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
বাদাখাশানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মোহিব-উল রহমান বলেছেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাদাখাশান প্রদেশের বেশিরভাগ এলাকা কোনো ধরনের সশস্ত্র লড়াই ছাড়াই দখলে নিয়েছে তালেবান। সরকারি সৈন্যদের দুর্বল মনোবলের কারণে তালেবান এই সাফল্য পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
রহমান বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো ধরনের লড়াই ছাড়াই বেশিরভাগ জেলার নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে গেছে। গত তিনদিনে ১০টি জেলা তালেবান নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে; এর মধ্যে ৮টিতেই কোনো লড়াই হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘শত শত আফগান সৈন্য, পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্য তাদের সামরিক তল্লাশি চৌকিতে তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং বাদাখশানের প্রাদেশিক রাজধানী ফাইজাবাদে পালিয়ে গেছেন।’
ফাইজাবাদের আশপাশের এলাকায় শক্তি জোরদারের পরিকল্পনা করতে রোববার সকালের দিকে একটি নিরাপত্তা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও প্রদেশের জ্যেষ্ঠ কিছু কর্মকর্তা শহর ছেড়ে রাজধানী কাবুলে চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন মোহিব-উল রহমান।
তালেবানের সাবেক ঘাঁটি কান্দাহার প্রদেশের প্রধান একটি জেলার নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে আফগান সামরিক বাহিনী। রোববার দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, রাতভর সেখানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের পর জেলাটি দখলে নিয়েছে তালেবান।
মার্কিন এবং ন্যাটো জোটের সৈন্যরা কাবুলের কাছের আন্তর্জাতিক প্রধান সামরিক ঘাঁটি বাগরাম ছেড়ে যাওয়ার মাত্র দু’দিন পর কান্দাহার প্রদেশের দক্ষিণের পানজওয়াই জেলার পতন ঘটেছে তালেবানের হাতে। বাগরাম ঘাঁটি থেকে গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে তালেবান এবং এর মিত্র আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছিল মার্কিন ও ন্যাটো জোট।
আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ তালেবানের তীর্থস্থান; ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের আগ্রাসনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানকার শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল তালেবান। পানজওয়াই জেলার গভর্নর হাস্তি মোহাম্মদ বলেছেন, রাতভর আফগান বাহিনী ও তালেবানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। যার ফলে সরকারি বাহিনী ওই এলাকা থেকে পিছু হটেছে।
ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, জেলা পুলিশের সদরদফতর এবং গভর্নরের কার্যালয় ভবন দখলে নিয়েছে তালেবান। পানজওয়াই জেলার পতনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কান্দাহারের প্রাদেশিক পরিষদের প্রধান সৈয়দ জান খাকরিওয়াল। তবে সরকারি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
সূত্র: এএফপি, এপি।
আরো পড়ুনঃ আফগানিস্থানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনা
আফগানিস্থানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ছিল তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিন সামরিক অভিযান পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় দুই দশক পর শুক্রবার সেই বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও সামরিক জোট ন্যাটোর সেনারা।
আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় সামরিক ঘাঁটি ছিল বাগরাম। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুক্রবার বাগরাম বিমানঘাঁটিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে জঙ্গি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালালে সামরিক আগ্রাসনে ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন সরকারে থাকা তালেবান। এরপর বিশ বছর ধরে তালেবানের সঙ্গে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর লড়াই চলছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানদের সঙ্গে হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবেই বাগরাম বিমানঘাঁটি খালি করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়বে সব মার্কিন সেনা।
গত বিশ বছরেও মার্কিন ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর কাছে পরাস্ত হয়নি তালেবান। ট্রাম্পের শাসনামলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচু্ক্তির অংশ হিসেবেই বাগরাম বিমানঘাঁটি খালি করে দেওয়া হয়েছে।
এক পর্যায়ে এই বিমানঘাঁটিতে এক লাখেরও বেশি মার্কিন সেনা ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মে মাসের মধ্যে সব সেনা প্রত্যহারের কথা থাকলেও নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে গত এপ্রিলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মে মাস নয়, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়বে সব মার্কিন সেনা।
এরপর মে থেকে আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করেন মার্কিন ও ন্যাটো সেনারা। বাগরাম বিমানঘাঁটি খালি করে দেওয়ার খবর জানিয়ে বিবিসি লিখেছে, এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার আসন্ন।
বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে বিদেশি সেনা এমন সময়ে চলে যাচ্ছে যখন সেনা প্রত্যাহারের কারণে সশস্ত্রগোষ্ঠী তালেবান গোটা আফগানিস্তানের দখল নিতে প্রচেষ্টা শুরু করেছে। দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিবিসি আরও বলছে, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরের বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে বিদেশি সেনা এমন সময়ে চলে যাচ্ছে যখন সেনা প্রত্যাহারের কারণে সশস্ত্রগোষ্ঠী তালেবান আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশের দখল নিতে শুরু করেছে।
প্রায় দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধের ইতি টানছে যুক্তরাষ্ট্র।
তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে এই বিমানঘাঁটিটিতে এক লাখেরও বেশি মার্কিন সেনা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সেনারা সরে যাওয়ায় ঘাঁটিটি এখন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আফগান বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কবে এই বিমানঘাঁটি হস্তান্তর করা হবে, সে সম্পর্কে মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা কিছু বলেননি। আফগান সরকারও জানিয়েছে, বিমানঘাঁটিটি আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) শুক্রবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন কূটনীতিকদের সুরক্ষা প্রদান ও কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুরক্ষায় এখনো আফগানিস্তানে প্রায় ৬৫০ জন মার্কিন সেনা থাকবে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছেঃ
গত বছর সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তালিবানদের এক চুক্তি অনুযায়ী এ বছর মে মাসের এক তারিখের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সেনাদের উপরে হামলা বন্ধ রাখতে হবে তালিবান বাহিনীকে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মাসে এই সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মতে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ পর্যন্ত আফগানিস্তানে সেনা উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন।
এই বছর নাইন ইলেভেন হামলার ২০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সেটিকে ঘিরে কোন ধরনের নিরাপত্তা-নিত হুমকির কথা মাথায় রেখে সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করার তারিখ বর্ধিত করা হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সময়ে আফগানিস্তানের অন্য ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের হামলা থেকে পশ্চিমা সেনাদের সুরক্ষা দিয়ে আসছে তালিবান বাহিনী।
যদিও আফগান নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের উপর তালেবানদের হামলা বন্ধ হয়নি।
সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সময়ে কোন ধরনের আক্রমণের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন জেনারেল স্কট মিলার।
তিনি বলেছেন, “ভুলে যাবেন না, যে কোন ধরনের আক্রমণের জবাব দেবার, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে আক্রমণে তাদের সহায়তায় সামরিক সক্ষমতা জোটের রয়েছে।”
অন্যদিকে চুক্তি সত্বেও তারিখ পিছিয়ে দেয়া সম্পর্কে তালিবানদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “চুক্তির লঙ্ঘন দখলদার বাহিনীর (পশ্চিমা সেনা) উপর তালিবান যোদ্ধাদের যেকোনো ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা নেবার নীতিগত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।”
তবে কোন ধরনের আক্রমণে যাওয়ার আগে তালিবান যোদ্ধারা তাদের নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষা করবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেনা প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়সীমা বড় ধরনের হামলা এড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
তবে সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে মার্কিন বাহিনী।
কোন সরঞ্জামগুলো দেশে ফেরত পাঠানো হবে আর কোনগুলো আফগানিস্তানে বাতিল হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হবে তার তালিকা তৈরি করছে তারা।