এম. নজরুল ইসলাম:
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি সবসময় উচ্চারিত হয়েছে পরম শ্রদ্ধায়। নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটিকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না। আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস ছিল, সহজ ছিল না তাকে আবিষ্কার করা। তার জীবনটা ছিল চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু সে পথের। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। এ জন্যই তিনি ছিলেন সব সময়ের জন্য সমসাময়িক। ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন তিনি। জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন ছিল না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি নিজেই এক ইতিহাসে পরিণত হয়েছিলেন। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছিলেন নিজেকে।
তার জীবনখাতার পাতাগুলোও ছিল বর্ণিল। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক ছিলেন তিনি। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে। পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরির্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। তার চেতনায় ছিল একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছিলেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছ থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০ ও ১৯৮৭ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এরপর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়ে হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে ছিলেন সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামের বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায় তার শেষ সলতে ছিলেন তিনি।
২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাকে। অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা ছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যে মানুষটি, তিনি হলেন তোয়াব খান। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এ দিনে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাকে, জানাই প্রণতি।
লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ