More

    বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র হুমায়ুন আজাদ

    তৌফিক আল ইমরান:

    আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

    নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক

    সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে

    চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল

    নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র

    আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে।

    বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মেধাবী সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ এভাবে দ্যর্থহীনভাবে লিখে গেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্য তথা সমাজ বাস্তবতা নিয়ে যে কজন মানুষ এভাবে নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে লিখতে পারতেন হুমায়ুন আজাদ নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী মননশীল-লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক ও গবেষক। ভাষা বিজ্ঞানে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা ভাষার অন্যতম সম্পদ তাঁর লেখা ভাষা বিজ্ঞানের আটটি বই, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লাল নীল দীপাবলি । তিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক তবে ৯০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ একজন শক্তিমান ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সর্বোমোট ১৩ টি উপন্যাস লিখেছেন তিনি । যেগুলোর ভাষাশৈলী অনবদ্য, কাহিনির গাথুনী বাস্তবসম্মত এবং রাজনৈতিক দর্শন সুগভীর । খ্যাতনামা এই লেখকের  উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ (১৯৯৪), ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসমূহ’ (১৯৯৬), ‘যাদুকরের মৃত্যু’ (১৯৯৬), ‘শুভব্রত’, ‘তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ (১৯৯৭), ‘রাজনীতিবিদগণ’ (১৯৯৮), ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ (১৯৯৯), ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ (২০০০), ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’ (২০০১), ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’ (২০০২), ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’ (২০০৩), ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ (২০০৪), ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪)।

    হুমায়ুন আজাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি এখনকার বুদ্ধিজীবিদের মত সুবিধাভোগী, ও তোষামোদকারী ছিলেন না। ক্ষমতার তোষণ করা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সমালোচনা করে লেখা শুরু করেন যার মাধ্যমে শুরু হয় তার রাজনৈতিক লেখালেখি।  সামরিক শাসনকে চরম বিরোধীতা করে তিনি লিখেছিলেন ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। এছাড়া তাঁর অন্যতম  প্রবন্ধগ্রন্থ গুলো হচ্ছে ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৮), ‘ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’ (১৯৯০), ‘নারী’ (১৯৯২), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২), ‘নিবিড় নীলিমা’ (১৯৯২), ‘মাতাল তরণী’ (১৯৯২), ‘নরকে অনন্ত ঋতু’ (১৯৯২), ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ (১৯৯২), ‘রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা’ (১৯৯৩), ‘শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা’ (১৯৯৩), ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ (১৯৯৩), ‘আধার ও আধেয়’ (১৯৯৩), ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনা ধারা’ (১৯৯৭), ‘মহাবিশ্ব’ (২০০০), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (মূল: সিমোন দ্য বোভোয়ার, ২০০১), ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ (২০০৩), ‘ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (২০০৪)। ‘নারী’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বেশ আলোচনা ও সমালোচনার  জন্ম দেয়। এমনকি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় এই তিনটি গ্রন্থ নারী, দ্বীতিয় লিঙ্গ এবং পাক সার জমিন সাদবাদ।

    আজ ২৮ এপ্রিল বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন । আজাদ ১৯৪৭ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে তাঁর দাদুর বাড়ি কামারগাঁওয়ে জন্ম নেন। তাঁর নাম প্রকৃত নাম ছিল হুমায়ুন কবীর। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নাম পাল্টিয়ে হুমায়ুন আজাদ হয়ে যান। তিনি ছিলেন প্রথাবিরুদ্ধ মানুষ, স্বঘোষিত নাস্তিক। যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কার বিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ৮০’র দশক থেকে পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে ছিলেন।  মুক্তমনা, সাহসী এই লেখকে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে একদল মৌলবাদী সন্ত্রাসী হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হুমায়ুন আজাদ সুস্থ হয়ে ওঠেন। ওই বছরের ৭ আগস্ট একটি গবেষণা বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানিতে যান। এর পাঁচ দিন পর ১২ আগস্ট মিউনিখের নিজ ফ্ল্যাটে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

    আমৃত্যু প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কারকে নির্মুল করতে কাজ করে গেছেন  হুমায়ুন আজাদ। ঘুনে ধরা আমাদের এই সমাজের কাঠামোয় আঘাত এনেছেন তার শানিত মস্তিস্কের বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর দ্বারা। তাঁর কলম তীক্ষ্ণ ছিলো কুসংস্কার ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে । বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রচলিত প্রথা ভেঙে দিয়ে নতুন কাঠামো  দাঁড় করাতে চাইতেন আজাদ।  সর্বত্র শোষণের  শোষণ ও অসংগতিপূর্ণ কাজের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি। কবিতা ও প্রবন্ধকে করেছেন প্রতিবাদের হাতিয়ার। অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথা নত না করা ছিল তাঁর  চরিত্রের দৃঢ়তা। অনিয়ম ও অন্যায় মেনে নেননি আজীবন।  রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক যে কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণে ছিলো তার প্রবল অনীহা, ব্যতিক্রম কিছু ছাড়া । অনর্থক ও অযৌক্তিক প্রশংসা করে শাসক শ্রেণীর মনজয় করেননি কখনই। নিজ বুদ্ধি ও বিবেচনায় যা ভালো, সেটাই গ্রহণ বা মেনে নিয়েছেন নিঃসংকোচে। আর এজন্যই  হুমায়ুন আজাদ অন্যান্যদের চাইতে অনন্য । ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে ও দৃঢ়ভাবে অন্যায্য তুলে ধরে বিরোধিতা করাই ছিল তাঁর চরিত্রের  অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাতে অন্যরা কীভাবে ভাববে, এ চিন্তা কখনই করতেন না তিনি। লক্ষ্য অটুট আর সংকল্পে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকা তাঁর চরিত্রের সবচাইতে বড় গুণ। তোষাণবিরুদ্ধ, চাটুকারিতাহীন এমন লেখক বাংলা সাহিত্যে খুব কমই ছিলেন ও আছেন। বিশেষত আমাদের এই  বাংলাদেশে।  প্রবন্ধ, কবিতা,  উপন্যাস, ভাষাবিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন  তুলনাহীন।

    ক্ষণজন্মা এই লেখক বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সম্পদশালী ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোর সাহিত্য, ৭টি ভাষা বিজ্ঞান বিষয়ক, সর্বমোট ৭০ টিরও বেশি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে। আর এজন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশের অন্যতম নক্ষত্র, যে নক্ষত্র দ্যুতি ছাড়াবে চিরজীবন, যতদিন বাংলা সাহিত্য বেচে থাকবে। আজ ২৮ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি বাংলা সাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা বিরল প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক কে।

    লেখক: স্নাতকোত্তর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img