ফারজানা রহমান, এ্যানি:
আমার সবচেয়ে প্রিয় ফল লিচু। এ জীবনে তা বুঝতে পেরেছি তা অনেক অনেক পরে। একজন মানুষের বিশেষ ভূমিকার কারণে। সে হলো উজ্জ্বল আমার জীবন সঙ্গী। সরকারি চাকুরে বাবা হিসাবের সঙ্গে জীবন চলছে তার আপন গতিতে।
আব্বা চেষ্টা করতেন আমাদের উনার সাধ্যমত সব সুযোগ করে দেবার। একজন দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি হতে পরিবার প্রধান হিসেবে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তা পুরণ করতেন।
আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা একটু বেশি ছিল। সাত ভাইবোনের সাথে সব সময় আত্বীয় স্বজনদের সমাগম বাসায় লেগেই থাকতো। তাই লিচু বাসায় আসলে ভাগাভাগি করে আমি যা পেতাম তা কখনো আমার মনকে তৃপ্ত করতে পারতো না।
ভাগে একটু বেশি লিচু পেতে চেষ্টা চালাতাম সব সময়। তারপর বয়ে গেছে অনেক দিন। কথা প্রসঙ্গে একদিন লিচুর প্রতি আমার এই ভালোবাসার কথা ও জেনে গিয়েছিল।
তারপর ঘটতে থাকলো অদ্ভুত মজার মজার সব ঘটনা। তখন আমি আর উজ্জ্বল বড় আপাদের সাথে পল্টনে থাকি। একুশ আমাকে ঘিরে থাকে। সব সময় ব্যস্ততা ঘিরে ছিল আমাদের নতুন জীবনে।
লিচুর সিজন শুরু হয়েছে। উজ্জ্বল দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লিচু নিয়ে আসছে। বড় আপা একুশকে সাথে নিয়ে ভাগ করে খাচ্ছি। বড় দুলাভাই আনলে তার ভাগও পাচ্ছি। নিজেও কিনে আনছি। লিচুর সময় আমি অন্য খরচ কমিয়ে লিচুর জন্য টাকা বেশি খরচ করতাম।
এর মধ্যে একদিন বাসায় ফিরে ঘরের কোণে কিছু একটা লুকিয়ে রাখা দেখলাম। জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল পরে দেখাবো । ঐটা তোমার জন্য। দেখলাম বাসায় লিচু খাওয়া হচ্ছে। আমিও ভাগে পেলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। বড়পা ঘুমিয়ে পড়েছে।
উজ্জ্বল আমাকে রান্না ঘর থেকে একটা ঝুড়ি আনতে বললো। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখা সেই যাদুর বাক্সের ভিতর থেকে আড়াইশ লিচু বের করলো।
আমাকে বসিয়ে খেতে শুরু করতে বললো। আমি কোন কথা না বলে খাওয়া শুরু করলাম। যতক্ষনে শেষ না হয়েছে আমি থামতে পারিনি । মাঝ রাত পর্যন্ত আমাদের এই মজার অভিজ্ঞতা চলেছিল।
তারপর খাবার পর এত লিচুর খোসা কোথায় ফেলা হবে তা নিয়ে তার পরিকল্পনা দেখে আমি অবাক। তখন বড় কালো পলেথিন খুব পরিচিত ছিল না। কোথায় থেকে তিনি সেটাও জোগাড় করে রেখেছে। সকালে অনেক কায়দা করে সেই লিচুর খোসা ফেলা হয়েছিল পরের দিন।
দেশে তত দিনে নানা প্রজাতির লিচুর আবাদ ব্যপক ভাবে শুরু হয়েছে। দেশিয় ঘুঁটি লিচুর পাশাপাশি বোম্বে লিচুকে পাল্লা দিতে বাজারে এসে গেছে চাইনা থ্রী,মোজ্জাফরের মত রসালো লিচুর জাত। দিনাজপুরের বিশেষ লিচু কদমা তো রয়েছেই।
এত জাতের যে লিচু আছে এবং কখন, কোথায় পাওয়া যাবে তত দিনে আমি রীতিমত বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি উজ্জ্বলের বৌদনতায় ! তার বউ যে লিচু খেতে পছন্দ করে মোটামুটি সবাই তা জেনে গেছে ইতিমধ্যে।
ছেলে হওয়ার পরও বাবা ছেলে মিলে আমাকে লিচু খেতে দিত। রাজশাহী তে থাকা অবস্থায় একশো লিচু বাসায় আসলে আমার জন্য বেশির ভাগ রেখে বাবা ছেলে লিচু খেত। লিচু খাওয়াতে কখনো আমার চক্ষু লজ্জার বালাই ছিল না কোন দিন, আজও নেই।
গত বছর শুরুর দিকে দিনাজপুর থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে বলেছিল সে দীর্ঘ দিন ধরে উজ্জ্বলের ফোন বন্ধ পাচ্ছে। তিনি বিপিএড পড়েছিল উজ্জ্বলের সাথে রাজশাহীতে। পুরাতন একটা ফোনে আমার নম্বর পেয়েছে।
কোন এক সময় উজ্জ্বল ভদ্রলোককে এই নম্বরে লিচু ঢাকায় কুরিয়ার করার জন্য দিয়েছিল। বলেছিল লিচু কতটা আমি পছন্দ করি। আমার কাছে উজ্জ্বলের এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা শুনে খুব দুঃখ পেলেন।
তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন আমার জন্য লিচু পাঠাবেন আগের মতই। তারপর বিশে বিষময় বিশ শাল । করোনা এখনো আমাদের করুনা করেনি তাই আমার তার পাঠানো লিচু আর পাওয়া হয়ে উঠেনি।
আজ অফিসে কাজ করছি। হঠাৎ টুং করে একটা শব্দ। দেখি ছেলে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। অনেক গুলো লিচু সাথে একটা স্টিকার। বড়পা লিচু কিনে দিয়ে গেছেন। সে আমার লিচুর প্রতি ভালোবাসার কথা জেনে লোভাতুর করতে চেষ্টা করেছে।
নিকটবর্তী সহকর্মীদের দেখালাম। বাসায় এসে দেখি অধিকাংশ লিচু রাখা আমার ঘরের কোণে তবে তা খোলা। এখন বাসায় শুধু মা ছেলে থাকি বলে আর আড়াল করার প্রয়োজন পড়েনি। তবে প্রকাশ ভঙ্গি প্রায় একই রকম। মনে হলো উজ্জ্বলের একটা ঝলক দেখলাম ,হয়তো এটাকেই বলে রক্তের বহিঃপ্রকাশ ,হয়তো তাই..