দেবযানী ঘোষ:
কিছু মানুষ থাকেন যারা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যান বটে কিন্তু তাঁরা নিজের নিজের জীবনেই এক একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ভাগ্যক্রমে ফেসবুক এর মাধ্যমেই অবগত হলাম এমনই এক প্রতিভাময়ী মানুষ সম্পর্কে। তাঁর কথা পড়তে গিয়ে যেমন চোখের জলে ভিজেছি।
তেমনই নিজেকে বড়ো ক্ষুদ্র মনে হয়েছে। ওই সময়কার একজন নারী হয়েও এমন পরমশক্তি ও আশ্চর্য গুনের অধিকারী। শ্রদ্ধেয়া আনোয়ারা রহমান।
তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি একজন মা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ পুলিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আজিজুর রহমানের স্ত্রী আর নারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ লায়লা পারভীন বানু’র জননী ।
১৯৪৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কোলকাতায় মন্তেস্সরী শিক্ষা পদ্ধতির ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনোয়ারা রহমান রাজশাহী’র সাধুর মোড়ে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র মন্তেস্সরী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।
শিশু শিক্ষার বিশেষ পদ্ধতি হিসাবে মাদাম মন্তেস্সরী উদ্ভাবিত এই শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই বহুল প্রচলিত। শহীদ জায়া এবং গর্বিত নারী মুক্তিযোদ্ধার জননী আনোয়ারা রহমান জন্মগ্রহন করেন ১লা অক্টোবর ১৯২৭ সালে অবিভক্ত ভারত তথা তৎকালীন বাংলার প্রধান শহর কোলকাতায়। তার পিতা ছিলেন একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও মাতা ছিলেন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত শিক্ষিকা।
১৯৪৫ সালে কোলকাতার এলগিন রোডস্থ লন্ডন ইউনাইটেড মিশনারি স্কুল ও কলেজ থেকে ২ টি লেটার সহ ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স/প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন।
মিশনারি কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে প্রায়শঃই মহীয়সী নারী মাদার টেরেসা’র সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে।
এই সময় মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের সাথেও তার কর্মযোগ ছিল। বেগম রোকেয়ার ওপর বিভিন্ন লেখালিখিও তিনি করেছেন যা তৎকালীন অনেক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে।
সিনিয়র টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে তিনি ডিস্টিংশন সহ সমগ্র বাঙলায় ৩য় স্থান অধিকার করেন। এরপর মন্তেস্সরী শিক্ষা পদ্ধতির ওপর বিশেষ কোর্স সমাপ্ত করেন।
১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে তার স্বামী আজিজুর রহমান পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। পুলিশের ওসি হিসাবে বিভিন্ন জেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় স্ত্রী আনোয়ারা রহমানও সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে শিক্ষকতা করেছেন। এরমধ্যে খুলনা করনেশন গার্লস স্কুল, বরিশাল ক্যাথলিক মিশন স্কুল প্রমুখ।
স্বামী আজিজুর রহমান ১৯৬৮ সালে রাজশাহী গোয়েন্দা দপ্তরে ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের পর ৬ সন্তানের জননী আনোয়ারা রহমান নিয়মিত শিক্ষকতা পেশা স্থগিত করেন ও নিজ বাসস্থান সাগরপাড়ার হিন্দু ধোপা অধ্যুষিত প্রতিবেশী শিশু-সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করেন।
২০০৫ সালে আদর্শ শিক্ষক ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য রাজশাহী মেট্রোপলিটন রোটারি ক্লাব “ ফেলোশিপ এ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট টিচার ” সম্মানে তাকে ভূষিত করেন। এছাড়াও রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ (পদ্মা মঞ্চ), রাজশাহী কো-অপারেটিভ সোসাইটি তাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেন।
বেগম রোকেয়া পদকের জন্য রাজশাহী বিভাগ থেকেও একসময় তার নাম মনোনীত হয়েছিল। স্কুল জীবন থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক ছিল এবং নিয়মিত চর্চাও করতেন ফলশ্রুতিতে দেশভাগের পর ঢাকা রেডিওর গানের অডিশনে “এ” গ্রেডের শিল্পী হিসাবে মনোনীত হন কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের নানা প্রতিকূলতায় সে প্রতিভা আর বিকশিত হয়ে ওঠেনি।
জীবনের ৮৫ বছরের অধ্যায়ে প্রায় সবটুকুই তাঁর কর্মময়। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি মনুষ্য ধর্মকেই সবচেয়ে বড়ো করে দেখেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর সুযোগ্য পুত্র আমিনুর রহমান বাচ্চু দাদা কে যে তিনি আমাকে এমন বিষয় টি তুলে ধরার সম্মতি দিয়েছেন। সমস্ত তথ্যও তাঁর থেকেই পাওয়া।
আমি ভীষণ ভাবে গর্বিত । তার একটি গানের ভিডিও পেয়েছি। এতটা বয়স সত্ত্বেও গলায় কি অসাধারণ সুর। সশ্রদ্ধ প্রনাম জানাই এই মহীয়সী নারী শ্রদ্ধেয়া আনোয়ারা রহমান এর প্রতি।
লেখক: কন্ঠ শিল্পী (কলকাতা)