ফারজানা রহমান, এ্যানি:
একজন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠা হয়তো বাংলাদেশের নারীদের এখনো অনেক দূরের পথ! কেউ হয়তো আমার এই কথাটা মানতে পারবেন না। আমি এটা খুব ভাল করে জানি। তবুও আজ এই কথাটা খুব জোর গলায় বলতে চাই। প্রায় কথা হয় সমমনা মানুষের সাথে। আমরা একটা শুভংকরের ফাঁকির পৃথিবীর বাসিন্দা।
সবাই ধরেই নেই যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী এমনকি জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী সে দেশের নারীরা তো অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। কথাটা যদি সত্যি হতো তবে আমার থেকে কেউ বেশী খুশি আর কেউ হতো না।
আমরা গত দুই দিন ধরে প্রমিলা ফুটবল দলকে কে নিয়ে বহু মাতামাতি করছি। আনন্দে ভেসে যাচ্ছি আর কেন আনন্দে ভাসবো না, আমাদের নারী দল তো সত্যি দেখিয়ে দিলো হাজারো বঞ্চনা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা জয় ছিনিয়ে আনতে পারে। একজন দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে লাল সবুজের পতাকার বাহক হয়ে বাংলাদেশের জয় জয়জয়কার করতে পারে।
আমিও দেশবাসীর মত আনন্দে ভেসে যাচ্ছি ।ভাবছি যদি সুযোগ থাকতো সব ফেলে এই সোনার কন্যাদের খোলা দোতলা বাস যখন বিমান বন্দর থেকে বাফুফে যাবে দুই হাতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে জনসমুদ্রের অংশ হতাম!
একজন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পক্ষে ময়মনসিংহ থেকে এই স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয় বিভিন্ন কারণে। তবুও শুভ কামনা নিরন্তর থাকবে বিজয়ী এই বাংলার বাঘিনীদের জন্য। এগিয়ে যা তোরা আরো আরো বহু দূর।
কষ্ট এক জায়গায় আমরা কি পেরেছি আমাদের এই নারীদের তথাকথিত বৈষম্য দূর করে প্রতিটি নারী-পুরুষ কে সম মর্যাদার অংশ করতে? না পারিনি,কি ভাবে পারবো আমরা এখনো নারীদের শ্রমের মূল্য দিতে জানিনা, জানতে চাই না।
জানলেই তো আমাদের সমস্যা। আমি বিস্মিত হয়ে বিজয়ী দলের নারীদের বেতন ভাতা দেখে কষ্টে ভেসে গেছি। এই যদি হয় বেতন বৈষম্যের নমুনা তবে এরা খেলা শেষে বাড়ি ফিরে গিয়ে পরিবারের জন্য, নিজেকে কিভাবে আরো দূরে নেওয়ার জন্য তৈরি করবে ,এ প্রশ্ন আমি নিজেকে করেছি? কারণ সেটা আমি পারি তাই।
সব শেষে নিজের একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি। সময়টা ১৯৯৮ সালের এমন সময় হবে। সদ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা পৌঁছেছি চাকুরীর খোঁজে। আমার তখন পরিবারের নিকট কোন আপনজন নেই যে আমাকে এনজিও লাইনে গাইড করবে।
অনেক টা পরনির্ভরশীল হয়ে এসিপিআর নামে একটি ফার্ম এ চুক্তি ভিত্তিক কাজ শুরু করেছি। কাজটা ছিল সারা বাংলাদেশ ঘুরে দলের সাথে থেকে স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক জাতীয় তথ্য জরিপ করা।আমি একটা দলের সুপারভাইজার। সেবার গেছি যশোরের কেশবপুর।
কাজ করতে হবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর বাড়ির এলাকা সাগরদাড়ি। থাকতে হবে ডাক বাংলোতে। তাই কেশবপুর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা অনুমতি দরকার । আমার কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চিঠি আছে।
তাই অনুমতি পাওয়া যাবে। বাইরে অপেক্ষা করছি কখন ডাক আসবে। এমন সময় উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার অফিস পিয়ন এসে জানালেন দলে পুরুষ সদস্য কে আছে ভিতরে যান। আমি জানতে চাইলাম কেন? বললেন স্যার কথা বলবেন।
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম এই দলের দলনেতা আমি তবে কি আমি যেতে পারবো না? একটু বিরক্ত হয়ে আমাকে রাস্তা ছেড়ে যেতে দিলেন। তখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন একজন নারী।
১৯৯৮ থেকে ২০২২ আমরা বাংলাদেশের পতাকা কোথায় না স্থাপন করিনি! তবে চিন্তার যে বৈষম্য তা আজো বিদ্যমান। এই চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন না হলে হয়তো এভাবেই একের পর এক সাফল্যের ধরা আমরা পাবো তবে গতি একটা নির্দিষ্ট বাক্সে আটকে থাকবে।
তাই বেগম রোকেয়া কে স্বরণ করে বলতে চাই, গাড়ির দুটো শটক (চাকা) যদি সমান না হয় তবে এই জায়গায় পাক খেতে থাকবে… শুভ কামনা সবার জন্য। আমি আজো ও স্বপ্ন দেখে যাই একদিন শুধু মাত্র অসহায় নারী নয় সত্যিকারের মানুষ হয়ে নিজের সব অধিকার আদায় করে নিবো।
প্রতি মুহূর্তের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের Google News, Facebook, Twitter, Linkedin এবং Instagram পেজ