জিহাদ বাবু:
দেশে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন, যখন তরুণদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ধর্মান্ধতার বিষ,যখন রাজনীতির নাম রাজনৈতিক কর্মীদের ভ্রাতৃ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তখন একজন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে আশাহত হই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। তবুও স্বপ্ন দেখা যায়,সপ্ন দেখি। জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন ‘ উপন্যাসের একটি লাইন সেই সপ্ন কে আরো প্রসারিত করে ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’
মাঝে মাঝে ভাবি তারুণ্যের এই অধঃপতন, এমন অসচেতনতা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ আসবে।কিভাবে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার খুটি হবে তরুণেরা।রোজ মাথায় ঘুরফাঁক খাই এই ছোট চিন্তা।উপায় খুঁজি, কিন্তু এত সাধ্য কি আছে আমার!
বন্ধুদের নিয়ে রোজ আড্ডায় আলোচনা হয় রাজনীতি,ইতিহাস আর সাহিত্য নিয়ে।কেউ কেউ বলে তোমার কাছে যে বই আছে আমাদের দাও পড়তে।কিন্তু বই হারানোর যন্ত্রনা আছে,সেই যন্ত্রনার অভিজ্ঞতা আছে আমারও।তবু মাথায় অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসে,ভাবলাম ওদের বই গুলো পড়তে দিলে কেমন হয়,সাথে সময় ও বেঁধে দিলাম এক সপ্তাহ।বইয়ের প্রতি যেন টান থাকে সেই জন্য একটা মূল্য ও ঠিক করে দিলাম,দশ টাকা।ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
শুরুটা ২০২০ সালের জানুয়ারীতে, মাত্র ৩৭ টা বই নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ফেসবুকে ব্যাপক সাড়া। এমনিতেই চট্টগ্রামের মূল ভূমি থেকে বিছিন্ন একটি দ্বীপ সন্দ্বীপ। নেই ভালো কোন পাঠাগার,লাইব্রেরীতে বিক্রি হয় শুধুমাত্র একাডেমীর বই।আমি শুরু করলাম ‘দশ টাকায় বই ‘ নামে বই পড়া কর্মসূচি। কোন স্থায়ী পাঠাগার না,একদম ভ্রাম্যমাণ ভাবে কার্যক্রম শুরু করলাম। সন্দ্বীপের প্রত্যাকটা স্কুল কলেজ থেকে নিয়মিত বইয়ের জন্য পাঠক আসা শুরু হলো।মাত্র দুই মাসে পাঠকের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গেল।আমি ভাবতে পারি নাই এই সল্প সময়ে এতদূর যাবে এই সামান্য কার্যক্রম।
সপ্ন ডানা মেলতে থাকে।আমার ধ্যান জ্ঞান সব কিছুই দশ টাকায় বই কর্মসূচি। ভেঙ্গে পড়া সমাজে আলো জ্বালানোর মাধ্যম পেয়ে গেলাম।এই মাঝে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বই পাঠাতে শুরু করলো।কর্মসূচি প্রতিদিন ই নতুন ভাবে সাজতে শুরু করলো।আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেক গুণ।চারপাশ থেকে প্রচুর অনুপ্রেরণা পাওয়া শুরু হলো।দশ টাকায় বই কর্মসূচিতে দিনে দিনে বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলো।বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বই সংগ্রহ করতে থাকলাম।
মাঝে করোনার প্রকোপে ও বই পড়া কর্মসূচি থমকে থাকে নাই।নিজে গিয়ে বা বিভিন্ন মাধ্যমে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিয়েছি।পাঠক সংখ্যা প্রায় ১৮০ যার মাঝে ১০০ জনের বেশি নিয়মিত পাঠক।
দশ টাকায় বই কর্মসূচি আজ প্রায় দেড় বছরের বেশি অতিক্রম করেছে।এই দেড় বছরে চার হাজার বারের বেশি বই পড়ানো হয়েছে।জানি পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তবে চেষ্টার নুন্যতম কমতি ছিল না।
দশ টাকায় বই কর্মসূচি আমার রোজকার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।ঘুম থেকে উঠা কিংবা রাতে ঘুমানো পর্যন্ত দিন কাটে এই বইয়ের আশেপাশে পাঠকদের নিয়ে বই সম্পর্কিত আলোচনায়।এটা কত শান্তি সেটা বলে বুঝাতে পারবো না।
জানিনা এই কর্মসূচি কতদূর এগিয়ে নিতে পারবো।এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি কতদূর হবে!তবে বিশ্বাস করি আমার জায়গায় কেউ না কেউ এই ঝান্ডা হাতে নিবেই।এগিয়ে নিবে এই আলোর মশাল,সমাজ পরিবর্তনের যে সংগ্রামে মাঠে নেমেছি কেউ না কেউ সেটা কে জ্বালিয়ে রাখবে।
এই কর্মসূচির সাথে যুক্ত পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।এই পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কারণে এই কর্মসূচি এতদূর এসেছে,আগামীতেও পাশে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বি:দ্র: মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত কলামের দায়-দ্বায়িত্ব লেখকের। প্রভাতী সংবাদ কর্তৃপক্ষ কোন দায় বহন করবে না।