দেবযানী ঘোষ:
কখনও কখনও নিস্তব্ধতা মৃত্যুর চেয়ে ও ভয়ঙ্কর।
এই দিনটির জন্য স্বাতী কোনওদিনই প্রস্তুত ছিল না।আজ তার ও বাবিন এর মধ্যে যে পাহাড় প্রমাণ নিস্তব্ধতার প্রাচীর তৈরী হয়েছে তাতে ফাটল ধরাতে পারে এমন কোনো সান্ত্বনার আশ্রয় স্বাতীর জানা নেই। বাইরের আকাশ থমথমে।
দূর থেকে স্বাতী দেখলো বাবিন ওর ঘরে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে বিছানার একপাশে বসে। হাতে ধরা একটি চিঠি। বাবিন এমন ভাবে বসে আছে যেন ওর দেহের সবটুকু প্রাণ কেউ শুষে নিয়েছে।
শুধু বুকের ক্ষীণ ওঠানামা টুকু দেখে বোঝা যায় যে ও বেঁচে আছে। কিন্তু স্বাতীর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব এই কয়েক পা এগিয়ে এসে ছেলেকে কাছে টেনে নেওয়া। হয়তো এ শীতলতা আমৃত্যু। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস এখন শুধু মাত্র গ্লানি বহন করে।
আজ থেকে ঠিক তিন বছর দু মাস দশদিন আগে পৃথা এই বাড়িতে এসেছিল বাবিন এর সাথে। তখন বৈশাখ মাস। শেষ বিকেলের তাপ যেন ওর ফর্সা গোল মুখটিতে গোধূলির রঙ মাখিয়ে দিয়েছে।
কিছুটা লজ্জার রঙ ও মিশেছিল বোধহয় তাই অমন টকটকে লাল হয়েছিল মুখটা। আর ওর পাশে বাবিন কে দেখে নিজের অজান্তেই মনে মনে দাঁতে নখ কেটেছিল স্বাতী। যেন কারো নজর না লাগে! নিজের নামটাও কি একবার নিয়েছিল?
পাশের বাড়ির উমা বৌদি বলেছিল ,
“”” সপ্তর্ষি আর পৃথা একেবারেই রাজজোটক স্বাতী ! সারাজীবন তো কত কষ্ট করলে। এবার নিশ্চয়ই তোমার সুখের দিন শুরু হলো!! “”
স্বাতী নিজেও তো এমনই ভেবেছিল। সেও তো বাবিনের আলো করা মুখটা দেখে এক অপার্থিব সুখ অনুভব করেছিল। তবু যে কেন এমন হলো!!
এখন শুধুই নীরব অপেক্ষার কারাদণ্ড। যেখানে দম বন্ধ হয়ে আসে। ছটফট করে ওঠে হৃৎপিন্ড।
রিসেপশনের সমস্ত পর্ব মিটতে মিটতে সেদিন বাজলো রাত একটা। সমস্ত অতিথিরা চলে গেলে পিপি ও বাবিনের বন্ধুরা নবদম্পতি কে নিভৃত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে যে যার মতো বিশ্রাম করতে চলে গেল। ফুলশয্যার রাত । এমন মুহূর্তের অপেক্ষা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের থাকে।
সপ্তর্ষি এগিয়ে এলো। পৃথার মুখটা তুলে ধরে বললো :::::: কয়েকটা দিন খুব কষ্ট হলো তোমার! না?
পৃথা আরও একটু কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে বললো ::::: মিস্টার!! এটুকু ধকল তো নিতেই হবে !! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দম্পতি যে !
সপ্তর্ষি ::::: ও আচ্ছা! তাই বুঝি? তাহলে তো…….. বলে ও পৃথা কে কোলে তুলতে যাচ্ছিল,
ঠিক এমন সময় দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা।
প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল দুজনেই। তারপর শুনল ওপাশ থেকে……. “”” বাবিন, বাবিন “””!!
সপ্তর্ষি এবার তড়িৎ গতিতে ছুটে গিয়ে দরজা খুললো। উদ্গ্রীব হয়ে বললো :::: মা!! কি হয়েছে!!শরীর খারাপ লাগছে তোমার?
স্বাতী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যেন সে সম্পূর্ণ বিবশ হয়ে রয়েছে। কিছু বলতে পারে না, হঠাৎ টলে যায় একটু।
সপ্তর্ষি সামলে নিয়ে জাপটে ধরে দুহাতে। বারবার বলতে থাকে কাঁপা স্বরে,… :::: মা, মাগো! কি হয়েছে তোমার বলো না !! অমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছো কেন?
স্বাতী ক্ষীণ স্বরে কোনো মতে বলতে পারে ::::: “”আমার বুকটা যেন কেমন ……. শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বাবিন! “”
“”” সে কি চলো চলো, ঘরে চলো তাড়াতাড়ি। আমি দেবায়ন কে ডাকছি। “””
সে মা কে একদম ছোট্ট মেয়ের মতো দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্বাতীর ঘরের দিকে চলে গেল।
ওদের পেছনে দরজা ধরে একজন মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থেকে গেল। এই আকস্মিক পরিস্থিতিতে কিছু বলবার সুযোগ ই পেল না পৃথা।
সানাইয়ে তখন বেজে চলেছে দরবারি কানাড়া।
দেবায়ন, বাবিন এর বন্ধু, পেশায় ডাক্তার। পাশের ঘরেই ছিল। বাবিন ডেকে আনলো। দেবায়ন সব দেখেশুনে একটু মুচকি হেসে স্বাতী কে বললো :::: “””বড্ডো বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছো মাসি। তোমারই একমাত্র ছেলে আছে বাব্বা!! আর আমরা তো সব ……!! হেসে ফেললো দেবায়ন :::::: “””কেন যে তুমি এত চাপ নাও?? “””
আর বাবিন কে বললো::::””‘ ওই ঘরে আয় আমি একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিই। ভয়ের কিচ্ছু নেই, ঠিক হয়ে যাবে। “”
বাবিন দেবায়নের সাথে বেরিয়ে গেলে স্বাতী মনে মনে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কেন ও এমন করলো!! ও তো এটা চায়নি। কিন্তু বাবিন ও পৃথা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর থেকেই এক অব্যক্ত যন্ত্রনা ওকে চেপে বসে।
তখন ও নিজের ঘরেই অনবরত পায়চারি করতে থাকে আর বোঝাতে থাকে নিজেকে যে, আজ কিছুতেই ওদের বিরক্ত করা যায় না। কিন্তু সেই কাজটাই কখন সে করে বসলো।””” হা ঈশ্বর!! কত ছোটো হয়ে গেলাম পৃথার কাছে আজ!! “”
বাবিন :::::”” মা! কি বলছো? ওঠো ওষুধ টা খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি বসছি এখানে। “”
স্বাতী ওষুধ খেয়ে ধীর কণ্ঠে বললো :::: “‘বাবিন আমি শুয়ে পড়ছি। তুই ঘরে যা। পৃথা একা আছে। আজ এমন একটা দিন!! “”‘
বাবিন :::: “”মা, তুমি কি জানো পৃথা কতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং!! ও খুব ভালো মেয়ে মা!! আমি তো বলছি ও কিচ্ছু মনে করবে না। তুমি শুয়ে পড়ো আমি ওকে বলে আসছি। “”
স্বাতী বাবিন কে বাঁধা দিতে গেল কিন্তু পেরে উঠলো না।
বাবিন ওর ঘরে এসে দেখলো পৃথা বসে আছে বিছানায়। ও বললো :::: “””পৃথা, লক্ষ্মী সোনা কিছু মনে কোরো না। দেখছোই তো মায়ের অবস্থা। এভাবে কি রাতে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে?? “””
পৃথা অবাক হয়ে ওর বড়ো বড়ো চোখগুলো মেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো :::: “”একেবারেই না! তুমি যাও মায়ের পাশে। আমার কোনো অসুবিধা নেই ,সপ্তর্ষি। “””
:::””” আমি জানতাম পৃথা। তুমি ভীষণ উদার মনের একজন মানুষ। হ্যাঁ আজকের দিনটা হয়তো আমাদের জীবনে আর কখনওই ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার মা এরকম বহু মূল্যবান সুখকেই শুধু মাত্র আমার জন্য দুহাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছে সারাজীবন। তাই আজকের দিনটা তুমি আমায় ক্ষমা কে দিও প্লিজ!! “”
বলে পৃথার গালে হাত রাখলো ও। আর বললো ::::: “”” তুমি রেস্ট নাও প্লিজ!! দরজা টা দিয়ে দিও কেমন!”””আর দাঁড়ালো না সপ্তর্ষি, চলে গেল মায়ের কাছে।
একটু পর পৃথা ধীরে ধীরে উঠে এসে আয়নার সামনে বসলো। কিছুক্ষণ নিজেকেই দেখলো যেন। তারপর এক এক করে সমস্ত সাজগোজ খুলে একটা ছোট্ট শাওয়ার নিয়ে রাত পোশাক পড়লো।
এরপর বিছানায় যেতে গিয়েও কি মনে হতে আস্তে আস্তে যেতে লাগলো স্বাতীর ঘরের দিকে। ওঁর ঘরের সামনে গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলো বাবিন বসে আছে খাটের গায়ে হেলাল দিয়ে আর স্বাতীর মাথা ওর কোলে। ছোট্ট মেয়ের মতো, মায়ের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে আর একহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাবিন। দৃশ্য সত্যিই স্বর্গীয়। কিন্তু পৃথার কোথায় সে একটি তার বেজে উঠলো তা ঈশ্বর জানেন। ও আর দাঁড়ালো না। চলে এলো নিজের ঘরে।
সপ্তর্ষি র সাথে পৃথার পরিচয় চাকরি সূত্রে। দুজনেই আইটি সেক্টর এ উচ্চপদস্থ কর্মচারী। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। এই পুরো দুবছরের পথ চলায় একে অপরের কাছ থেকে ওরা নিজেদের কোনোরকম ছোটখাটো বিষয় আড়াল করে নি। বিশেষ করে ওদের বেশিরভাগ গল্পই ছিল স্বাতীকে ঘিরে।
কারণ সপ্তর্ষির বাবা রেল এ চাকরি করতেন।একটা ভয়ানক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।তখন সপ্তর্ষি মাত্র চার বছরের।
সেই থেকে একদিকে চাকরি, অন্যদিকে সপ্তর্ষি আর পিপি মানে স্বাতীর একমাত্র ননদ এই দুজনের দায়িত্ব স্বাতী পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ঘরে বাইরে, সামাজিক, মানসিক, শারীরিক লড়াইয়ের সাথে সবরকম ইচ্ছা – অনিচ্ছা, ভালোলাগা- মন্দলাগা ,পাওয়া – নাপাওয়া সবকিছু কে সহস্র যোজন দূরে সরিয়ে ওঁর ছিল একটাই কেন্দ্র ,একটাই বৃত্ত। তা হলো বাবিন। এর মধ্যেই ননদের পড়াশোনা,বিয়ে দেওয়া ।
সম্বল বলতে উত্তর কলকাতার সম্ভ্রান্ত এলাকার এই বাড়িটি। স্বাতীর শ্বশুরের তৈরী করা।
তাই সপ্তর্ষি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর volunteer retirement নিয়ে নেয় স্বাতী। সপ্তর্ষি ওদের সম্পর্কের শুরু থেকেই বলে এসেছে এসব কথা। ওর মায়ের কথা। মা ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই বা কিচ্ছু নেই সে কথাও।
কিন্তু পৃথার শিক্ষা, রুচি, বুদ্ধি এমনই পরিণত যে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল সপ্তর্ষির এই সহজ, নিষ্পাপ মন কে।ও যেন ঠিক ঝর্ণার মতো । তাই মায়ের প্রতি এই অবসেশন থাকা সত্ত্বেও সপ্তর্ষির ভালোবাসায় ও নিজেকে উজার করে দেয়।এবং ও নিজের উপর এতটাই কনফিডেন্ট যে এসব ব্যাপার কখনই বাঁধা হয় নি ওর জন্য।
কিন্তু আজ যেন পৃথার সমস্ত তার একসাথে বেসুর বাজছে। তবুও ও জোর করে মনকে শান্ত করতে চেষ্টা করলো।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিনিয়তই,দিনের বেলা যেমন স্বাতী রোজ নিজের হাতে দুজনের খাবার গুছিয়ে হাসিমুখে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে ওদের একসাথে অফিস যাওয়া দেখতো এবং ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই নিজেকে শাসন করতো, মনে মনে শপথ করতো যে আজ থেকে ও একদম স্বাভাবিক থাকবে।
ঠিক তেমনই রাতের খাওয়া- দাওয়ার পর্ব শেষ হলে বাবিন ‘ মা ‘ কে জড়িয়ে ধরে গুডনাইট বলে পৃথার সাথে করিডর ধরে হেঁটে ঘরের দিকে যেতো এবং দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই তার ভেতরের সমস্ত বালির বাঁধ ভেঙেচুরে, শপথের পাহাড় দুমড়ে মুচড়ে আবারও সেই একই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতো স্বাতী।
কখনও বাবিন কে আটকে রাখতো ভয়, বুক ধড়ফড়, একা লাগা এসবের অছিলায়। আবার কখনও নিজেই বসে যেতো রাজ্যের গল্প নিয়ে ওদের ঘরে। এক একদিন ক্লান্ত পৃথা ঘুমিয়েই পড়তো কথা শুনতে শুনতে।
কত রাত সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে ওদের দরজার বাইরে। অন্তরঙ্গ কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করেছে। সারারাত কেঁদেছে।
পৃথা সবকিছুই বুঝতে পারতো। কিন্তু ও এতটাই পরিমিত বোধসম্পন্ন যে একজন অসহায় মায়ের সাময়িক মানসিক দৌর্বল্য কে সে স্নেহের আশ্রয় দিয়েছিল। আবার বাবিনের অনুপস্থিতিতে স্বাতী ও পৃথার সম্পর্ক খুব ই স্বাভাবিক। দুজনেই দুজনকে আদরে, যত্নে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। পৃথা একদিন ও এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি।
এভাবেই চলছিল।কিন্তু স্বাতীর একদিনের ব্যবহার পৃথার বুকে শেষ পেরেক টা পুঁতে দিল।
সেদিন ছিল ওদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। সারাদিন পিপি, পিসুন আরও কিছু বন্ধুদের সাথে বাড়িতে ছোটো একটি অনুষ্ঠান হলো। সন্ধ্যার পর সপ্তর্ষি বললো :::::: """ মা!! আমাদের তো আজ অফিস কলিগদের সাথে একটা পার্টি আছে। ফিরতে অনেকটা রাত হবে। তুমি বরং পিপির সাথে ওদের বাড়িতে যাও। কাল অফিস থেকে ফেরার সময় আমরা তোমায় নিয়ে আসবো। কেমন!! "" বলে মায়ের গালটা ধরে একটু আদর করে দেয় ও।
স্বাতী ::: ওহ্!! আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে কাল আমায় নিয়ে আসিস। আমি তৈরী থাকবো। আর সকালে একটা ফোন করিস কিন্তু।
সপ্তর্ষি::::: “”” হ্যাঁ মা!! নিশ্চয়ই করবো। তুমি তো কোথাও যাও না। পিপির ও ভালো লাগবে তুমি গেলে। “””
পৃথারা বেরোনোর আগেই পিপির সাথে স্বাতী চলে গেল।
পৃথারা যখন ফিরলো প্রায় রাত তিনটে। দুজনেই ভীষণ ক্লান্ত। দরজার লক খুলে ঢুকলো এবং কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজেদের ঘরে চলে গেল।
ঘরের দরজা আলগোছে ভেজিয়ে দিয়ে সপ্তর্ষি পোষাক ছাড়তে থাকা পৃথাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলো।
বহুদিন পর ওরা নিজেদের মধ্যে এমনভাবে ডুবে গেল। ঠিক যখন ওরা চূড়ান্ত অবস্হায় পৌঁছেছে তখন ঠাস করে দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে স্বাতী ।
খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো :::::”” বাবিন আমার মাইগ্রেন এর ওষুধ টা একটু খুঁজে দিয়ে যাস তো!! “” বলে চলে গেল। যেন কিছুই হয় নি।
ওরা দুজনেই যেন মুহূর্তে বিদ্যুৎপৃষ্ট । এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে যে নিজেদের ঢাকতেও ভুলে গেল ওরা।
এরপর থেকেই পৃথা প্রায়ই বলতে লাগলো সপ্তর্ষি কে :::: “”” মায়ের সত্যিই একজন বিশেষজ্ঞকে দেখানো প্রয়োজন। তুমি প্লিজ একটা ব্যবস্থা করো। “”””
সপ্তর্ষি:::: পৃথা এটা আমিও মানি। কিন্তু কি করে এই কথাটা মা কে আমি বলি বলোতো??
পৃথা ::::: তাঁর ভালোর জন্যই তো করছি না?? তুমি এভাবে ভাবছো কেন?
সপ্তর্ষি:::: আমি তোমাকে হারাতে চাই না পৃথা। আর মা কেও আমি কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না এভাবে।
বলতে বলতে পৃথা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে সপ্তর্ষি।
পৃথা সান্ত্বনা দেয় ওকে। ওর ছেলেমানুষের মতো মনটাকে পৃথা সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে।
সপ্তর্ষি বহু চেষ্টা করে মা কে আশ্বস্ত করতে। তার ইনসিকিউরিটি দূর করতে। পিপি এসেও বোঝাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু সমস্যা হলো স্বাতী তো অবুঝ নয়। সে নিজেও পরাজিত, লজ্জিত নিজের কাছে। ওর মানসিক বৈকল্য ওকে তাড়িত করে আর সপ্তর্ষির মায়ের প্রতি আবেগ ওকে সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিতে দেয় না।
এর ফলে ধীরে ধীরে পৃথা ও সপ্তর্ষি র দূরত্ব বাড়তে থাকে , শিথিল হয় সম্পর্ক।
একদিন সন্ধেবেলা পৃথা অফিস থেকে ফিরে দুজনকে দুরকম চমক দিল পৃথা। এক ওয়াশিংটনে একটি প্রোজেক্টের জন্য তার ওখানে যাওয়ার সংবাদ অন্যটি ডিভোর্স নোটিশ।
সপ্তর্ষির দেহমন সম্পূর্ণ অবশ হওয়া সত্ত্বেও মিউচুয়াল ডিভোর্সের প্রাথমিক কার্যকলাপ মিটে গেল। স্বাতী হাজারো অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ, উপরোধ করে টলাতে পারেনি পৃথা কে। সপ্তর্ষি একটা কথাও বলে নি। অনায়াসে যেতে দিয়েছে পৃথা কে।
একমাসের মাথায় পৃথা চলে গেছে ওয়াশিংটন। আবার হয়তো ফাইনাল শুনানি তে আসবে। সপ্তর্ষি থেকে গেছে তার একমাত্র অস্তিত্ব নিয়ে। সে তার মায়ের সন্তান। বাবিন নির্ভুল পালন করে তার সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য।
মা কে একইভাবে আদর,যত্ন করে সে।কিন্তু স্বাতী জানে আজ বাবিনের মধ্যে শুধু জমাট বাঁধা কালো মেঘ। এ মেঘ কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরবে না। কখনো ঝড় হয়ে সবকিছু চুরমার করে দেবে না। এর থেকে মুক্তি নেই।
আজ পৃথার চিঠি টাই বাবিনের হাতে। ফোন, মেইল এর যুগেও পৃথা চিঠি পাঠিয়েছে ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে……
সুধী,
আগামী মাসে আমাদের কেস এর ফাইনাল শুনানি। আমি মাত্র একটি কথা জানাতেই এই চিঠি লিখছি। যখন আমি তোমাদের ছেড়ে চলে এসেছিলাম তখন আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেদিন বলতে পারিনি কারণ নিজেকে গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লেগে গেল। আর শেষ দুমাস সপ্তর্ষির সাথে শীতলতা এমন বেড়ে গেছিলো যে ও কিছুই জানতে পারে নি।
কিন্তু গত পরশু আমি একজন পুত্রসন্তানের মা হয়েছি। যার বায়োলজিক্যাল ফাদার সপ্তর্ষি। তাই এই বিষয়ে জানার অধিকার তোমাদের আছে। আমি আশা করবো এই সন্তান আমাদের কেস এর অন্তরায় কখনওই হবে না। যে এসেছে তার দায় নিতান্তই আমার। জীবনের কাছে একটি সত্য যাচাই করার অপেক্ষায় আমিও রইলাম।
কোনও “মা ” যদি তার সর্বস্ব নিঃশেষ করে সন্তানকে মানুষ করে তোলে একা, তখন কি সত্যিই বিনিময় টুকুই প্রাধান্য পায়?? আমিও এই উত্তরটুকু পাওয়ার অপেক্ষায় আজ থেকে দিন গুনবো।
ভালো থেকো তোমরা!!
লেখক: শিক্ষিকা ও কন্ঠ শিল্পী