More

    একজন অগ্রগামী নারীর কথা

    ফারজানা এ্যানি:

    ট্রেনটা ছুটে চলছে বন্দর নগরীর পথে। শেষ মুহূর্তে এই টিকিট পাবো আশা করিনি। কি কারণে যেন বাস মালিকদের অবরোধ চলছে। হাতে টাকাও বেশি নেই। ইচ্ছে করলেই বিমানে যেতে পারতাম না। পাশের রুমের ছোট ভাই খবর পেয়ে বললো আমি আপনার একটা ব্যবস্থা করতে পারি যদি আপনি একজন কে সাথে নিয়ে উনার ঠিকানা মত পৌঁছে দেন? প্রথমে বুঝতে পারিনি বয়স্ক এমন কোন নারীর কথা বলছে। কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম।

    ট্রেনে উঠার পর বুঝলাম কি প্যারার মধ্যে পড়ে গেছি। যাকে পৌঁছে দিতে হবে সে একজন সত্তর বছর বয়সের নারী। বয়স হলেও কি হবে একদম ফিটফাট নারী। আমার সাথে পরিচয়ের শুরুতে জানিয়ে দিলেন শুধু শুধু আমাকে তার সাথে যোগ করে দেওয়া হয়েছে।তিনি সব একাই করতে পারতেন। এখানো তিনি তার সব কাজ নিজে নিজে করেন। নাম বললেন মমতাজ বেগম।এই ফাঁকে আমার নাম শুনে বললেন বাবা আবির আমার নাতি-নাতনি থাকলে তোমার মত হতো । তাই তুমি আমাকে দাদু ডেকো। আশা করি আমাদের যাত্রা আনন্দের হবে।

    আমি নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় আর বলি সন্ধ্যায় আবৃত্তির প্রোগ্রাম না থাকলে এই প্রস্তাব নিতাম না। সারা রাস্তা এই বুড়ো দাদুর নানা রকম আবদার শুনতে শুনতেই কাটবে । একটু বিশ্রামের দরকার ছিল সেটা আর হবে না। তবে টঙ্গী স্টেশন পার হলে আমি অবাক হয়ে দেখলাম মমতাজ দাদু ছোট একটা ফ্লাস বের করে ওয়ান টাইম দুটো গ্লাসে চা ঢেলে আমাকে বললেন ধরো চা খাও। বিস্কুট নিবে?
    আমার মনে হলো এটাই তো আমি মনে মনে খুঁজছিলাম । ট্রেনের বুফের চা থেকে নিশ্চিত ভাল হবে।মুখে দিয়ে মনে হলো এত সুপেয় চা বহু দিন পর খেলাম।

    এতক্ষণে দাদুর দিকে একটু ভাল করে খেয়াল করলাম তার সাথে একটা ছোট ব্যাগ আর একটা খাবার দাবারের ঝুড়ি। একহারা গড়নের কারণে বয়স হিসাবে বেশ সুস্থ আছেন। কথা এতক্ষণে হাতে গুনে বলেছেন। চলতি পথে সব প্রয়োজন নিজে নিজে সমাধান করছেন। আমি সত্যি তার কোন প্রয়োজনে আসছি না। এই বয়সে কানে হেডফোন দিয়ে খুব মজা করে চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন।

    একটা স্টেশন পার করছি আর অবাক হচ্ছি। খুব ইচ্ছে হলো দাদুর সাথে আলাপ করতে। একটু একটু করে কথা শুরু করলাম। জানতে চাইলাম আমার পাশের রুমের রুদ্র তার কি হয়?

    দাদু হেসে বললেন আমার বোনের নাতি। ঢাকায় অল্প ছুটি গুলো আমার সাথে কাটায়। এবার বলেছিলাম চল আমার সাথে। কি যেন একটা জরুরী কাজ আছে তাই যেতে পারবে না। কিন্তু ও আমাকে একা ছাড়তেও রাজি হলো না।বললো দেখি তোমার সাথে তাজ দাদু কাওকে সঙ্গে দিতে পারি কিনা। আসলে রুদ্র আমাকে খুব ভালবাসে । ওর মা যখন ইডেন কলেজে লেখাপড়া করতো তখন আমার কাছেই ছিল। আমি ওকে মেয়ের মত মানুষ করেছি। সে সব কথা থাক। তুমিতো শুনেছি উত্তরবঙ্গের লোক। এখনো লেখাপড়া করছো মেসে থেকে। হঠাৎ কি কারণে চট্টগ্রামে ছুটছো বাছা?

    বললাম কবিতা আবৃত্তি করতে যাচ্ছি। স্থানীয় কিছু সংগঠন মিলে কবিতা উৎসব করছে। ঢাকায় শিল্পকলায় জাতীয় কবিতা উৎসবে ওদের সাথে আলাপ হয়েছিল। আজ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কবিতা আবৃত্তি করার । তাই আসা । আগামীকাল সকালে আমি একটু শহর দেখে রাতে ঢাকা ফিরবো।

    মমতাজ দাদু বললেন আমিও তো আগামীকাল ফিরবো। আমার কাছে দু’টো টিকিট আছে রাতের ট্রেনের । তুমি চাইলে আমার সাথে ফিরতে পারো ।ও আচ্ছা কোথায় উঠবে? বললাম আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় উঠতে হবে। স্টেশনে ওদের থাকার কথা। আপনি কোথায় উঠছেন দাদু?এত অল্প সময়ের সফর কেন , জরুরী কিছু ?

    প্রশ্ন শুনে একচোট মন খুলে হেসে নিলেন।খেয়াল করলাম সেই হাসিটায় বড় মায়া আছে। খুব আগ্রহ হলো এই সত্তর বছরের নারীকে জানার ।

    বললেন উঠবেন পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনিতে এক আত্মীয় আছেন তাদের কাছে। স্টেশনে তাদের আসার কথা । আগামীকাল উনার সত্তর তম জন্মদিন। হয়তো বা হতে পারে এটাই তার শেষ জন্মদিন! তাই জন্মস্থান শেষবারের মত দেখে যেতে চান ,তাই আরকি তার এই ভ্রমন।

    আমি আবারো চমকে গেলাম।ভেবে অবাক হলাম যে দেশে মেয়েরা এখনো এত উন্নত জীবনের পরেও নিজেকে এতটা দৃঢ় ভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি সেখানে একজন সত্তর বছরের নারী এভাবে ঘুরে বেড়ায়!

    ভদ্রমহিলার সম্পর্কে আমার আগ্রহ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। শুনলাম তার জীবনের নানা কথা। বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পছন্দের জীবন সঙ্গী বেছে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন বেসরকারি চকুরে ছিলেন । শখ ছিল পৃথিবী ঘুরে দেখার। ইচ্ছে ছিল নিজেদের একটা বাড়ি হলে চাকরি ছেড়ে শুধু সংসার করে কাটিয়ে দেবেন । কঠিন বাস্তবতা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। হিসেবে বড় গোলমাল হয়ে গেছে।

    আরো হয়তো অনেক গল্প হতো । চোখে পড়লো সীতাকুণ্ড উঁচু উঁচু টিলা। দূর থেকে মন্দির দেখা যাচ্ছে। দাদু বললেন আমরা মনে হয় অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবো। আহা আবির তোমার মোবাইল নাম্বার ই তো নেওয়া হলো না। আমি দাদুর নাম্বার টা নিলাম। বললাম যোগাযোগ করে নিবো।

    ট্রেনটা ধীর গতিতে চট্টগ্রাম স্টেশনে প্রবেশ করলো । সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো ট্রেন থেকে নামার জন্য। আমরাও নেমে এলাম। দাদুর আত্মীয়রা দাদুকে নিয়ে এগিয়ে গেল আর আমি একজন অগ্রগামী নারীর দৃপ্ত পদচারণা দেখতে দেখতে আমার পথে এগিয়ে গেলাম..

    লেখক: কবি, সাহিত্যিক ও উন্নয়ন কর্মী

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    spot_imgspot_img