তালুকদার লাভলী:
তেরতম ভাদরের স্নিগ্ধ শুভ্র সন্ধ্যা। নদী তীর ঘেষে কাশফুলের শুভ্র হাসি যেন পৃথিবীর এই করোনা প্রলয়ে প্রকৃতিকে নূতন করে বাঁচার প্রেরণা দিচ্ছে। আকাশে চলছে মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খুনসুটি।
এ সবই বলে দিচ্ছে জীবন চলছে জীবনের গতিতে সময় বয়ে ঠিকই যাচ্ছে। তবুও এই গতির মধ্যে, বহতার মধ্যে আচানক কোনো কোনো নক্ষত্র খসে পড়ে মহাশূন্যের অজানা পথে।
রেখে যায় এক শূন্যতা, এক নিরন্তর বেদনা। তেমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শব্দশ্রমিক আলোর প্রদীপ আমাদের মাঝে জ্বেলে দিয়ে (২৮ আগস্ট, ২০২১) শনিবার সন্ধ্যা ৬ টার সময় খসে পড়লেন লেখকের পাতা থেকে, চিরতরে থেমে গেল চলমান একটা বুদ্ধিদীপ্ত কলম। জাতি হারাল একজন আলোকিত মেধাকে।
আমরা হারালাম একজন লেখককে। তার পরিবার হারিয়েছে একজন অবিভাবকে। আমি হারালাম একজন বন্ধুকে। তার প্রয়াণে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। তার চলে যাওয়া আমাদের মাঝে যে শূন্যতা তৈরী হল তা কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়।
যার প্রথম লেখা ‘টোকা কাহিনী দখল করেছিল পাঠকের মন। যার সঙ্গে কথায় আড্ডায় পার হয়ে যেত গোটা দিন। অনেক অনেক স্মৃতি লেখকের সঙ্গে। প্রায়ই ধ্রুব এষের বাসায় বসত আমাদের আড্ডা।
সে আড্ডায় বুলবুল চেীধুরীর সঙ্গে থাকত শিশু সাহিত্যিক আবু সাঈদ জুবেরী, ধ্রুবদা ও আমি। আবার কখনো লেখকের বাসায়। বেশীর ভাগ কথা হত লোখালেখি নিয়ে।
আর বুলবুল ভাই নিজের জীবনের মজার মজার কাহিনী শুনাত। আমি যখন তার লেখা পড়ি তখন দেখি এসব তো আমার পরিচিত। তার মুখ থেকে শুনা কাহিনীগুলো থেকে পূর্বেই পরিচিতি ঘটেছে আমার।
কি সুন্দর করে সেই জীবনের কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে শব্দের সারিতে বসিয়ে তৈরী করতেন গল্প, উপন্যাস। লেখকের জীবনটা ছিল যেমন অনাড়ম্বর, প্রতিক্রিয়া নির্বিকার মুখ, বয়সী খাতায় সংখ্যা বাড়লেও তারুণ্যে ভরা পবিত্র যৌবন দীপ্তি পৌরুষের জ্যোতি, সরলতার আলো মুখে, ভালোবাসার সঞ্জীবিত চোখে তাকাতেন গভীর করে। দৃষ্টিতে ব্যক্তিত্বের বিস্তার ।
অথচ বিনীত। মাথায় বাউলা চুল। বহমান গ্রামের শান্ত নদীর মতোন বয়ে চলছে। এই চলার পথে যেতে যেতে আমার জীবনের বৈচিত্রগাথাঁ কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, সৌজন্য আর আন্তরিকতায় বলতেন, লাভলী আপনার জীবন গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, অন্তর স্পর্শ করেছে।
আরো জানব আর লিখব আপনাকে নিয়ে। আমার ‘কাল পুত্র’ উপন্যাসটির নামকরণ করেছিলেন বুলবুল ভাই। এছাড়াও আমার অন্যান্য উপন্যাসের নাম রাখা হত এই আড্ডায় বসে। আমার প্রথম উপন্যাস ‘তদবিরে তকদির’ পড়ার মধ্য দিয়ে প্রথম পরিচয় কথাসাহিত্যিক বুলবুল চেীধুরীর সঙ্গে।
ষাটের দশকে আর্বিভূত সৃজনশীল কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট আলোকিত কলম হাতে গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় সাংবাদিকতা করেছেন সমকাল সহ দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি দৈনিকে।
লেখক সমকাল থেকে বিদায় নেবার পর বেশীরভাগ সময় গ্রামে কাটাতেন। স্বপ্ন দেখতেন গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে। আর সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিয়ে শুরু করলেও সফল হতে পারেনি। আসলে যার হাতে কলম সফল তার হাতে অন্যকিছু শোভনীয় নয়।
বাউলা স্বভাবের লেখকের গোটা জীবন একটা উপন্যাস। তিনি চশমা চোখে জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরতেন। চশমা চোখে জলের নিচে পরিষ্কার দেখেতেন মাছদের চলাফেরা।
অবাক লাগলেও এটা সত্যি। তিনি ছিলেন নিতান্তই মামুলি মানুষ। বিনোদন বলতে আড্ডা আর লেখা। দামী রেস্টুরেন্ট বা বিলাসি পানীয় তার জীবনকে স্পর্শ করেনি।
তার আগ্রহ ছিল গাঁজার প্রতি। দোষ বা নেশা যাই বলি ঐটুকুন। আমি প্রশ্ন করতাম গাঁজা খেলে কি হয়? কেন এটা খান? উত্তরে সে বলত, গাঁজা খেয়ে লিখতে বসলে সম্পুর্ণ মনোযোগ লেখার মধ্যে থাকে। দুনিয়ার কোনো কিছু আর মনে স্থান পায় না।
লেখকের মজার একটা ঘটনা,- বাসে দেখা হয়েছিল এক বেদে মহিলার সঙ্গে। বাসে তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জেনেছিল তার নাম। আর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। কোন একদিন মনে পড়ে সেই বেদেনিকে।
পথে নেমে পড়লেন বেদেনির খোঁজে। নারায়ণগঞ্জের অলিগলি খোঁজে প্রথম দিন না পেলেও দ্বিতীয় দিন পেয়েছিলেন। আমি হেসেছিলাম, অবাক হয়েছিলাম। আসলে এসব ছিল তার লেখার মূল।
লেখক নারায়ণগঞ্জের পতিাতা পল্লীতেও সময় কাটিয়েছেন। কোনো জৈবিক কারণে নয়, শুধু গল্প করে জেনেছেন তাদের জীবন গাথাঁ। প্রকৃত লেখকরা এমনই হয়।
তার লেখায় কোনো রাজনীতি ছিল না, কোনো বিতর্ক ছিল না। তার লেখায় ছিল প্রান্তিক মানুষের জীবনগাঁথা, তাদের সারল্য প্রেম, সংগ্রাম, তাদের জীবনের জটিলতা।
লেখকের গল্পগ্রন্থ-টোকা কাহিনী, পরমানুষ, মাছের রাত, চৈতির বউ গো । উপন্যাস,অপরূপ বিলঝিল নদী, কহকামিনী. তিয়াসের লেখন, অচিনে আঁচাড়ি, মরম বাখানি,এই ঘরে লক্ষী থাকে। ইতু বৌদির ঘর, দখিনা বাও, জলটুঙ্গি, পাপপুণ্যি,ঘরবাড়ি, দম্পতি, বলো কি অনুভবে।
কিশের গ্রন্থ-গাঁও গেরামের গল্পগাঁথা, নেজাম ডাকাতের পালা, ভালোভুত, প্রাচীন গীতিকার গল্প। আত্মজৈবিক গ্রন্থ- জীবনের আঁকিবুঁকি ও অতলের কথকতা।
শব্দের বাগানে ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, সে ফুলের রূপ-রস সুধা গন্ধে বিমোহিত সকল পাঠক। প্রচার বিমুখ এই লেখক নিরবে পাঁপড়ি মেলেছিল, সুগন্ধ বিলিয়েছিল আর তার উজ্জ্বলতা চারদিক আলোকিত রেখে ৭৩ বছর বয়সে নিরবে চোখ বন্ধ করলেন।
লেখকের চলে যাওয়া ব্যথার ক্ষত হয়ে থাকবে হৃদয়ে। মীর আবুল খায়েরের কবিতার দুটো লাইন বার বার মনে পড়ছে।
’রিংকন পাহাড়ের সেই পথ আর সেই আমরা ছ’জন
একত্র হবো না আর এ জীবনে হঠাৎ কখন’।
লেখক ঘুমিয়ে আছেন মিরপুর বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। তার মেধার কাছে, মননের কাছে চির কুতজ্ঞ আমি এবং আমরা।
’আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে
সকল অন্ধকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’।
বিনম্র শ্রদ্ধা ও অশ্রুর পুষ্পাঞ্জলি।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক এবং যুগ্ম সম্পাদক, পেন বাংলাদেশ
প্রয়াত লেখক বুলবুল চৌধুরী সম্পর্কে অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম। লেখকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।