More

    স্যার শুনতে আগ্রহবোধ একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতা

    আমার মনে পড়ে, বছর দুয়েক আগে কোনো একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমি কল করেছিলাম মহেশপুরের সাবেক ইউএনও শ্রদ্ধেয় কামরুল ইসলাম রনি’র কাছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমি কথা বলার একপর্যায়ে তাঁকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে ফেলি। পরে যখন নিজের অনিচ্ছাকৃত অথচ স্বভাবসুলভ ভুলটা বুঝতে পেরে তাঁর কাছে দুঃখপ্রকাশ করলাম, উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আরে না-না, ভাই বলাতে কোনো অসুবিধা নেই শিশির। তুমি বলতে পারো।”

    শিশির ওয়াহিদ:

    সামান্য ইউনিয়নের সচিবকেও এখন ‘স্যার’ ডাকা লাগে। নয়তো তারা বেজায় চটে যান। অন্য এলাকার ইউপি সচিবরা এমনটা করে কি-না জানিনা, তবে আমার এলাকায় এমনটা ঘটে এটা হলফ করে বলতে পারি।

    ইউপি সচিবদের হাল যদি এই হয়, তাহলে তার থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কথা নাই-বা বললাম!

    এই যে কলোনিয়াল লিগ্যাসি এবং ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া মনোভাব, এটা আঁকড়ে ধরেছেন এদেশেরই কিছু তথাকথিত শিক্ষিত চাকুরেরা। ‘স্যার’ ডাক যে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, তা এই তথাকথিত শিক্ষিত গুলোর জানা নেই। স্যার না ডাকাতে এরা সাধারণ মানুষকে অপমান অপদস্ত করার মতোও ঘটনা ঘটাচ্ছে।

    সম্প্রতি এক সরকারি কর্মকর্তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ নিয়ে গেছিলাম। শালিন, মার্জিত ও সম্মানের সাথে কথা বললেও স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই উনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার সাথে অতিরিক্ত রাগান্বিত স্বরে কথা বলেছেন। তার কথায় আমি মারাত্মক ভাবে ব্যথিত হয়েছি। তাঁর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে এত নিচুমানের আচরণ আমি একদমই আশা করিনি।

    আমার প্রসঙ্গ সেটা নয়। ঐ কর্মকর্তার সাথে ছিলো আরেক কর্মকর্তা (পদাধিকারবলে নিচু), কথা শুনে মনে হয়েছিলো লোকটি নেহাতই ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটির মুখে ‘স্যার’ শব্দটির অবাধ ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে তিনি ঐ কর্মকর্তাকে এতবার স্যার ডেকেছেন, যে ডাকতে ডাকতে তিনি নিজেও কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছেন, এসি চললেও উনার মুখ আর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ার চিত্র এখনো চোখে ভাসে। গুণলে হয়তো স্যার ডাকার সংখ্যা অর্ধশতক পূর্ণ করতো!

    অনেকদিন আগের আরেকটি ঘটনা। একবার আমার এলাকায় একটি ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলাম। তখন ইউপি নির্বাচন চলছিলো।

    ওইদিন ভোটকেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে হটাৎ ভিড় দেখে দৌড়ে গেলাম, দেখলাম পুলিশের এস.আই পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এক ব্যক্তির শার্টের কলার ধরে অশ্লীল ভাষায় রাগান্বিত স্বরে বলতে লাগলো, “….এত টাকা দিয়ে চাকরি করছি, আমারে স্যার ডাকবি না-তো কী ডাকবি!!”

    ঝামেলাটা যখন মিটলো, তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে বর্ণনা শুনে বুঝলাম লোকটি ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে স্যার না ডেকে ‘ভাই’ ডেকেছিলো। এতেই চটে গিয়ছিলেন তিনি। অতঃপর বাকবিতন্ডা।

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভেবেছিলাম ‘মানুষ এত বিকৃত মানসিকতার হয় কিভাবে!’

    আমার সামনে ঘটে যাওয়া দুইটা ঘটনার উদাহরণ দিয়েছি মাত্র। কিন্তু এই চিত্র গোটা দেশের; প্রতিনিধিত্ব করে গোটা দেশকেই। স্যার না ডাকাতে সরকারি কর্মকর্তারা কি কি করছেন, তা এই সহজলভ্য ইন্টারনেট আর পত্রপত্রিকার বদৌলতে ইতোমধ্যে আমাদের প্রায় সবারই জেনে থাকার কথা।

    তবে এটাও উল্লেখ করতে হয়, সব কর্মকর্তা এক নয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

    আমার মনে পড়ে, বছর দুয়েক আগে কোনো একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমি কল করেছিলাম মহেশপুরের সাবেক ইউএনও শ্রদ্ধেয় কামরুল ইসলাম রনি’র কাছে। সে সময়ে তিনি ছিলেন সম্ভবত বাগেরহাটের এডিসি। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমি কথা বলার একপর্যায়ে তাঁকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে ফেলি। পরে যখন নিজের অনিচ্ছাকৃত অথচ স্বভাবসুলভ ভুলটা বুঝতে পেরে তাঁর কাছে দুঃখপ্রকাশ করলাম, উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আরে না-না, ভাই বলাতে কোনো অসুবিধা নেই শিশির। তুমি বলতে পারো।”

    খাঁটি মানুষের পার্থক্যটা এখানেই। কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার কারণে দুর্নামের প্রভাব বিস্তার করছে প্রায় সবার মাঝেই।

    সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনে আইনগত ও সাংবিধানিক কোনো ভিত্তি নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের ভুলে গেলে চলবেনা তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক।

    বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, সেবকের স্থান কীভাবে মালিকের উপরে হয়! উন্নত দেশে গণকর্মচারীরাই সেবা গ্রহীতাকে স্যার বলেন।

    ‘স্যার’ ডাক শোনার প্রবণতা থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। একজন সেবা গ্রহীতা ‘স্যার’ সম্বোধন করে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধের সাথে তাঁর সমস্যার সমাধান চাইতে পারে, তার চাইতে হাজারগুণ বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, নিঃসংকোচ বোধ করে ‘ভাই কিংবা আপা’ ডেকে।

    স্যার ডাকে যে কথা বলা যায়না, সে কথা ভাই ডাকে খুব সহজেই বলে ফেলা যায়।

    লেখক : সংবাদকর্মী

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img