নিশাত বিজয় :
বিচারপতি যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনের সদস্য থাকার ইতিহাস নিজ মুখে স্বীকার করেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পরিবারের সাথে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাক্ষাৎ করেন তাহলে সেই বিচারপতি তার গ্রহণযোগত্য হারিয়ে ফেলেন, রাষ্ট্র সেই বিচারপতির ক্ষমতার ভার সহ্য করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দিকে সেইসব অপরাধের তীর তার দিকে উঠেছে, তখন তার বিচার করবে কে! সেজন্য তাকে এই সব অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে, কারণ তার কোন সহকর্মী তার সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সম্মত ছিলেন না। ফলে বিচার বিভাগের অচলাবস্থা কাটানোর জন্য তার প্রস্থান ছিল জরুরী।
সম্প্রতি বিচারপতি সিনহা তার “এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি” বইতে তিনি অনেক অভিযোগ-অনুযোগ তুলেছেন। কিন্তু যখন প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে দেশ, জাতির পিতা, সংসদ নিয়ে অবমাননাকর কথা বলেছেন, সেই কারণে তার পাশে তিনি তার সহকর্মী বিচারপতি থেকে দেশের সর্বস্তরের জনগণের তোপের মুখে পড়েছেন। সেটি উনি বোধহয় ভুলেও গেছেন।
তিনি রায়ে উল্লেখ করেছিলেন দেশের জন্য যারা লড়াই করেছে তারা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ অথচ আমাদের বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এককভাবে স্বীকৃত এবং এই দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশের সূর্যসন্তান, তারা ‘ফাউন্ডিং সান”। অথচ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিতর্কগুলো উত্থাপন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশের ইতিহাস নিয়ে কাঁটাছেড়া করার সুযোগ তৈরির অপচেষ্টা করেছেন। এজন্য জাতি তাকে সারাজীবন ঘৃণাভরে দেখবে।
বিচারপতি সিনহা ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মামলা চলাকালে নিজ মুখে স্বীকার করেন যে ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের শান্তি বাহিনীর সদস্য হয়ে কাজ করেছেন। সেই নিউজ প্রকাশিত হয়েছিল ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সালে ‘জাস্টিস সিনহা ডিসকোলজেস হিজ রোল ইন ১৯৭১’ শিরোনামে।
এসকে সিনহার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর সংলগ্ন খিলক্ষেত এলাকায় আশিয়ান সিটির পক্ষে রায় দিতে ৫০ কোটি টাকা ঘুষের অভিযোগ তোলেন এক ব্যবসায়ী। বিচারপতি সিনহার পক্ষে তার পিএস রঞ্জিত সিঙ্গাপুরে আশিয়ান সিটির এমডি নজরুল ইসলামের কাছে থেকে এই অর্থ গ্রহণ করেন।
মানবতাবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত সাকা চৌধুরীর বিচার চলাকালে তার পরিবারের সাথে অবৈধ ও বেআইনী ভাবে সাক্ষাৎ করেন। এই দিকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তরে তার ভূমিকার সাথে এই কর্মকান্ডের মিল, এটি কী তার আদর্শ নাকি কাকতলীয় সেটি উদ্বিগ্ন করে তোলে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীকে বাঁচাতে তার ভাইয়ের কাছে থেকে ৫০ হাজার ডলার অর্থ সংগ্রহের অভিযোগের তীরও উঠে। সর্বোপরি তার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সঙ্গী-সাথীদের বাঁচাতে প্রধান বিচারপতি হবার পরে চেষ্টা শুরু করেন আদর্শিক ও আর্থিকভাবে।
বিচারপতি সিনহা তার বইয়ের শিরোনামে ‘ব্রোকেন হার্ট’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। তার কোন স্বপ্ন ভেঙেছে? যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে নাকি পাকিস্তানের মতো সেনাবাহিনীর সহয়তায় কোন পুতুল সরকার ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সেই স্বপ্ন। কারণ তার পাকিস্তান-পন্থার প্রতি প্রেম একাত্তরেও দেখা গেছে আর ২০১৫’তেও দেখা গেছে। বিচারপতি সিনহাদের পাকিস্তান পন্থা থেকে দূরে সরে এসে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে, তাদের স্বপ্ন সাম্প্রতিক অতীতেও পূরণ হয়নি আর বর্তমানেও হবে না। সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে, বাস্তবতার মুখ আর দেখবে না।
বি:দ্র: মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত কলামের দায়-দ্বায়িত্ব লেখকের। প্রভাতী সংবাদ কর্তৃপক্ষ কোন দায় বহন করবে না।