নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনার মত মহামারীর মধ্যেই বিশ্বে আরেক আতঙ্কের নাম ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক। এরমধ্যে সারাবিশ্বে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত অনেক রোগীই মারা গেছেন। যারা সুস্থ্য হয়ে ফিরেছেন, তাদের চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ধারণার অতীত।
বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত পাঁচজন রোগীর মধ্যে একজন মারা গেলেও একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অন্য দুই জন সুস্থ হওয়ার পথে। আর একজন কাউকে কিছু না বলে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
এই ছত্রাকে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার খুবই বেশি। পাশাপাশি ব্যাপক চিকিৎসা ব্যয়ের বিষয়টিও চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
বাংলাদেশে এই রোগের চিকিৎসায় ওষুধ উৎপাদন হলেও ভারতের মতোই যদি বাংলাদেশেও ছড়ায়, তাহলে সেই কোম্পানিটি চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, সেটি সরকারকেও জানিয়েছে।
এর মধ্যে গত ২৪ মে গণমাধ্যমে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার খবর আসে। সেই রোগী ছিলেন বারডেম হাসপাতালে। বিষয়টি সে সময় তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।
পরদিন হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়, একজন রোগী এরই মধ্যে মারা গেছেন আর একজন চিকিৎসাধীন আছেন। পরে আরও তিন জনের সংক্রমণের তথ্য আসে, যাদের মধ্যে একজন ভর্তি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
বারডেম হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘করোনা পরবর্তী জটিলতায় নিয়ে বারডেম হাসপাতালের ভর্তি হয় ৫৫ বছর বয়সী একজন রোগী। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। তিনি এক মাস ২১ দিন আগে করোনা থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দুই এক দিনের মধ্যে গায়ে জ্বর দেখা দেওয়া তিনি আবার খুলনা হাসপতালে চিকিৎসা নেন। ওখানার চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে বারডেমে নেওয়া হয়। এক সপ্তাহ আগে সুস্থ হয়ে তিনি বাসায় ফিরেছেন।’
তিনি জানান, আজ সেই রোগী আবার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছিলেন। তার সামান্য কাশি রয়েছে। সাতক্ষীরা অবরুদ্ধ থাকায় তিনি বর্তমানে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় রয়েছেন।
এই রোগী পাঁচ বছর ধরে ডায়বেটিসে ভুগছেন। সঙ্গে হাঁপানির সমস্যাও আছে।
হাসপাতালে চার সপ্তাহে কেমন খরচ হলো, সেই তথ্যও জানিয়েছেন অধ্যাপক দেলোয়ার। জানান অ্যান্টি ফাঙ্গাস ইনকেজশন দিতে হয়েছে প্রতিদিন। এ জন্য দিনে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। হাসপাতাল শয্যা ও অন্যান্য খরচ এর বাইরে।
বারডেম চিকিৎসা নিতে এসে যে রোগী কাউকে না বলে চলে গেছেন, তার কোনো খোঁজই মিলছে না।
অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, ‘তার বিষয়টি নিয়ে আমরা বিস্তারিত বলতে পারব না। আর এখন যে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি সুস্থ হওয়ার পথে।’
গত ১৪ জুন খুলনা থেকে আসা এক রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ধরা পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তিনিও প্রায় সুস্থের পথে।
চিকিৎসা কী?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ প্রভাতী সংবাদকে জানান, এই রোগের চিকিৎসা হয় চার ভাগে।
আক্রান্ত ব্যক্তির যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে প্রথমে সেটি নিয়ন্ত্রণে নিতে হয়। রোগী আগে থেকে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে সেটিও অনেক কমিয়ে দিতে হবে।
এমন কিছু রোগের ক্ষেত্রে রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমানোর ওষুধও দিতে হয়। তবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হলে সেসব ওষুধও বন্ধ রাখতে হয়।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসবিরোধী একটি ইনজেকশন আছে। সেটি প্রয়োগের পাশাপাশি কোনো স্থানে যদি ক্ষত তৈরি হয়, সেই ক্ষতটি কেটে ফেলতে হয়। চোখে ক্ষত হলে চোখও তুলে ফেলতে হয়।
নার্জাল এন্ডোস্কোপি করে যদি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয়, তাহলে বিদ্যুতের শকও দেয়া হয়।
মৃত্যুহার যেমন বেশি, তেমনি সমস্যা হচ্ছে এর চিকিৎসার খরচ।
চার থেকে ছয় সপ্তাহ রোগীকে ফলোআপে রাখতে হয়। আর এই সম্পূর্ণ সময়টি হাসপাতালে ভর্তি থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানাচ্ছেন অধ্যাপক শরফুদ্দিন। এত দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকলে যে খরচ তা অনেকের পক্ষেই সামাল দেয়া কঠিন।
যে ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়, তার একেকটির দাম ১৫ হাজার টাকা। দেশে সংকট দেখা দিলে ওষুধের দাম বাড়ার অতীত ইতিহাস আছে।
দেলোয়ার হোসেন জানান, এই ইনজেকশন দিতে হয় স্যালাইনের মাধ্যমে। দিনে দুই থেকে তিনটিও লাগে কখনও কখনও। দুই সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহে এই ইনজেকশন দিতে হয়।
দিনে দুটি লাগলেও যদি দুই সপ্তাহ দিতে হয়, তাহলে কেবল ইনজেকশনের খরচ দাঁড়ায় ২ লাখ ১০ হাজার, আর যদি ছয় সপ্তাহ দিতে হয়, তাহলে খরচ হবে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
তিনটি করে লাগলে দুই সপ্তাহে ইনজেকশনের পেছনে খরচ হবে ৩ লাখ ১৫ হাজার, আর ছয় সপ্তাহে ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম ব্রিফিং করে জানিয়েছেন, এই চিকিৎসার ব্যয় কমানোর উপায় খুঁজছেন তারা। এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে আলোচনা করা হচ্ছে। এই ছত্রাক বৃদ্ধি পেলেও যাতে ওষুধের দাম না বাড়ে, সে বিষয়ে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে।
ছোঁয়াচে নয় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস
কিছুটা স্বস্তির বার্তা হলো, চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ‘পারসন টু পারসন’ অর্থাৎ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। তার পরেও সতর্ক থাকতে হবে এই ছত্রাক নিয়ে।
বারডেম হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যে কেবল করোনার কারণেই হবে, সেটা নয়। ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড’ ইনফেকশনও হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘তাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রোগীদের পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং দরকার না হলে স্টেরয়েড ও অক্সিজেন না দেয়ার মতো কাজগুলো করতে হবে।’
কখন আক্রমণ করে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস পরিবেশে সব সময়ই থাকে। থাকে মানুষের শরীরেও। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে এটা রোগ হিসাবে দেখা দেয়।
বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাদের ঝুঁকি বেশি। আবার স্টেরয়েড গ্রহণ করা ব্যক্তিরাও এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
তিনি জানান, এই ছত্রাক নাক, চোখ এবং কখনও কখনও মস্তিষ্কে আক্রমণ করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগটির নাম মিউকরমাইকোসিস। করোনাকালে ভারতে ছড়াচ্ছে করোনা থেকে সেরে ওঠার পর।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, করোনা থেকে মুক্ত হলেও শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে পেতে সময় লাগে বেশি।
আর এই দুর্বল সময়ে আঘাত হানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। আর এই রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি; শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত মৃত্যুর তথ্য আছে।