More

    মায়ানীল ওই নোনা চোখে

    দেবযানী ঘোষ:

    মানুষের জীবনে চাওয়ার সাথে পাওয়ার অভিসার এমনই রহস্যময় যে এই দুইয়ের মিলন যেন এক মরীচিকা। বেশিরভাগ মানুষ জানে না সে সত্যিই কি চায়। আর যা সে পায় তা কি আদতেই তার চাওয়া ছিল! সমান্তরাল এই শব্দদ্বয় সারাজীবন মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। হয়তো নিয়তির ফেরে কখনও তারা বিন্দুতে মিলিত হয় অথবা সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকে আজীবন।

    দক্ষিণ কোলকাতার ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিস। এখন পিক আওয়ার্স।ওয়াশরুম থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসে রেহান । মুখোমুখি হয় জয়ীতার। একটু হলেই ধাক্কা খেতো। এই ব্যস্ততার সময়ও ওই একই ভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। অস্বস্তি বোধ করে রেহান। কিন্তু ইগনোর করে সরে যায় ওখান থেকে। এরপর কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। ব্রেক এর সময় কলিগ আকাশ ওকে জিজ্ঞেস করে ….

    ” কি রে , কি নিয়ে তুই এত ডিসটার্বড রয়েছিস কদিন ধরে? “
    রেহান —- আরে নাহ্, সেরকম কিছু না। বলার মতো কিছু হলে তোকে অবশ্যই বলবো।
    আকাশ —- আচ্ছা। তারপর বল তোর pre wedding preparation কেমন চলছে? Feeling excited?
    একটু দায় সারা ভাবে রেহান বলে — এই তো চলছে রে। বাড়ীতে গেলেই তো খালি এই সব ই। শাড়ি গয়না খাবার মেনু, কোন লোক নিমন্ত্রিত হবে….. চলছে আর চলছেই। আমি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছি।
    আকাশ ::::—– আর সে ? মানে আমাদের তুলিকা ম্যাডাম ? তার কি খবর ? ।

    মৃদু হেসে রেহান বলে ::::: “আছে ভালোই । সে তো ভীষণ ব্যস্ত সবসময়। এবং আশ্চর্য ভাবে দিন রাত কখনও সে ক্লান্ত স্বর এ কথা বলে না। একটা দীর্ঘশ্বাস অবধি কখনও শুনিনি জানিস। আমরাও তো মাঝে মাঝে ডিপ্রেসড হই। বোর হই।টায়ার্ড হই।ও এমন কিচ্ছু হয় না। সবসম যেন টগবগ করে ফুটছে। একেবারে অন্যরকম। মাঝে মাঝে ওর কাছে নিজেকে বড্ডো কম মনে হয়। মনে হয় ওর উপস্থিতি এতোটাই ব্রাইট যে সেখানে অন্য সবকিছু খুব ম্লান দেখায়।

    আকাশ ::: আরে তুই কি এসব নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছিস নাকি?
    রেহান কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু,
    ওরা কথা বলতে বলতেই আরও অনেকে চলে আসে । সবাই মিলে চেপে ধরে রেহান কে।
    দীপ্ত :::: স্যার হানিমুনে কোথায় যাবেন?
    মিমি :::: আরে ছাড়তো আগে বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খাই। কি দাদা?
    রেহান :::; হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
    কৌশিক :::: আমাদের would be বৌদি মনি তো just one and only….. Damn smart আর ফাটাফাটি সুন্দরী। তেমনই শিক্ষিতা , independent একজন নারী। স্বয়ং সম্পূর্ণা।
    রেহান কিন্তু ভীষণ লাকি।
    সবাই একসাথে হেসে ওঠে।

    করিডোর এর কোনায় দাঁড়িয়ে জয়ীতা অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে সারাক্ষণ একভাবে তাকিয়ে আছে । কিই যে ভীষণ ভাষাময় ওই চোখ জোড়া। সেটা লক্ষ্য করে, রেহান আবার ও অন্যমনস্ক হতে থাকে।

    দেখতে দেখতে রেহান ও তুলিকার এনগেজমেন্ট এর দিন এসে পড়ে। বিরাট আয়োজন। এতো হই হট্টগোল, আলো ঝলমলে রাত কিন্তু তবুও অনুষ্ঠান পর্বে তুলিকা বারবার অনুভব করতে থাকে রেহান অন্যমনস্ক। ও লক্ষ্য করলেও কিছু বলে না। অনুষ্ঠান শেষে রেহান কে যখন একটু একা পায় তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায় হাতে ভদকার গ্লাস নিয়ে। জিজ্ঞেস করে —

    তুলিকা —-” Anything wrong? “
    ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব ভাবনার জগত থেকে তুলে এনে রেহান বলে ::::— Nope ….. nothing….. I’m absolutely fine…. তুমি এনজয় করছো তো?
    তুলিকা :::::: I always enjoy every beat of life….. So that’s not the issue…..
    তবে আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো কিছু নিয়ে worried …… Anyway যদি নিজে সালটাতে না পারো আমায় বোলো।
    বলে চোখ মেরে হি হি করে হেসে ফেলে ও। হাতের এমন ভঙ্গি করে যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিল সব।
    রেহান -:–yah of course…. But nothing to worry about…..
    বলে হালকা করে ওকে একটা টাচ দেয়।

    যদিও তুলিকা বোঝে এটা সান্ত্বনা। তাই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসে।
    তুলিকা এবার রেহানের পিঠে একটা চাপড় দিয়ে ওকে চিয়ার আপ করে আর জোর করে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়।

    সবাই চলে গেলে রাতে ছাদে যায় রেহান। পায়চারি করতে করতে ভাবতে থাকে যে ও কি ঠিক ডিসিশন নিচ্ছে। তুলিকার আড়ালে ও কোথাও ঢাকা পড়ে যাবে না তো?

    অন্যদিকে আর একটা ভাবনাও অবচেতনে ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জয়ীতা মাত্রই কয়েক মাস হলো এসেছে ওদের অফিসে । এ মেয়েটি ভীষণ রহস্যময়। অদ্ভুত ভাবে শুধু তাকিয়ে থাকে। কখনও কিচ্ছু বলে না। কিন্তু ওর চোখ দুটো যে কতো অজস্র কথা বলে চলে তা ও নিজেও হয়তো জানেনা।

    রেহান প্রথম প্রথম বেশ একটা মজাই অনুভব করতো কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে ও কেমন যেন সম্মোহিতের মতো না চাইতেও বারবার জয়ীতাকেই লক্ষ্য করতে থাকে। কিছুতেই ওই চোখ দুটোর আকর্ষণ থেকে

    নিজেকে বের করতে পারছে না। ও জেগে, ঘুমিয়ে, চেতনে অবচেতনে সবসময় যেন ওই দৃষ্টির কাছে নতজানু।
    এক গভীর সমুদ্রের মতো চোখ জোড়া। রেহান ওই চোখে তাকালেই যেন অতলে তলিয়ে যেতে থাকে।
    এসব ভাবতে ভাবতেই তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেললো রেহান।
    চতুর্থ টা ধরাতে গিয়ে মাটিতে ফেলে “ধুত্তোর…. ” বলে পিষে ফেলে নীচে নেমে এলো। যেন নিজের ভাবনা কেই পিষে ফেললো।
    পরদিন জয়ীতা আসে রেহান এর কেবিনে। হাতে কয়েকটি ফাইল নিয়ে।
    জয়ীতা — . ” আসবো স্যার? “
    একটু চমকে ওঠে রেহান।
    রেহান —- হ্যাঁ হ্যাঁ এসো। বলো কি ব্যপার? তুমি তো খুব বেশি দিন জয়েন করোনি তবুও তোমার report যথেষ্ট ভালো কাজ এর ক্ষেত্রে।
    জয়ীতা-::::—thank you sir….( আবার একঝলক ওরকম ভাবে তাকায়। আর এলোমেলো হয়ে যায় রেহান। চোখ সরিয়ে নেয়। )
    রেহান ::::— হ্যাঁ বলো কি কাজে এসেছো?
    জয়ীতা -::: — স্যার এই ফাইল টায় কিছু গন্ডগোল দেখছি। আমাদের নতুন clients এরা। আপনি একটু check করে রাখবেন। আর বলছিলাম বালি তে আমাদের যে প্রোজেক্ট টা চলছে ওখানে কা আপনি ভিজিট করবেন নাকি আকাশ স্য?
    রেহান — ওটা আকাশ ই করবে। তুমি ওই ফাইলটা ওকে দিয়ে দিও।
    জয়ীতা মাথা দোলায়। ” আসছি স্যার ” বলে চলে যায়।

    জয়ীতা খুব শান্ত ও নরম স্বভাবের মেয়ে। খুবই কম কথা বলতে দেখেছে রেহান ওকে। যেন মাটি ব্যথা পাবে এমন করেই ও হাঁটাচলা করে। কথা বলে মৃদু স্বর এ। গোল ধরনের ছোট্ট একটা মুখ । যার মধ্যে শুধু ওই চোখ দুটিই সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়।

    কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব ভাবতে থাকে রেহান। তার মধ্যেই তুলিকার ফোন আসে একবার।
    রেহান–:- হ্যাঁ বলো তুলিকা।
    তুলিকা— আজ একটু কিছু কেনাকাটা করার ছিল। তুমি কি আসতে পারবে?
    রেহান -::– আমি একটু ব্যস্ত তো। কেন মিলি নেই?
    মিলি তুলিকা র বন্ধু।
    তুলিকা–::::– হ্যাঁ, মিলি আছে। কিন্তু তোমার সাথে ও একটু দেখা হয়ে যেত। সেই জন্য ই বললাম। but it’s ok…. I’ll manage…. Don’t worry….
    রেহান—- ok all right….. তুমি কাজ complete করে সিসিডি তে এসো। ওখানে meet করছি আমরা।ok?
    তুলিকা ::::—ok… Fine… Bye .
    রেহান::— bye .

    অফিস শেষ করে রেহান গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। হঠাৎ রাস্তার মধ্যে দেখে জয়ীতা চোখ বন্ধ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ও গাড়ি সাইড করে একটু নেমে দেখে। তখনই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় জয়ীতা । রেহান দৌড়ে গিয়ে ধরে। উঠিয়ে আবার ছেড়ে ও দেয়।
    জিজ্ঞেস করে,
    ;—- ” কি ব্যপার? তুমি এরকম করে হাঁটছো কেন? “
    জয়ীতা —(একটু ম্লান হেসে) মাঝে মাঝে আমার এরকম ইচ্ছে হয়। যদি আমি অন্ধ হতাম? তাই এরকম যারা কোনো একটা অঙ্গ ছাড়া বেঁচে থাকে, খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমি feel করতে চাই ওদের কষ্ট টুকু।
    রেহান অবাক হয়ে তাকায়। বলে কি মেয়ে টা?
    জয়ীতা -:— যাই হোক, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সাহায্য করার জন্য।
    রেহান বিদায় নেয় কিন্তু আবারও ঘেঁটে যায়। আজ ই ও ঠিক করেছিল একদম মন অন্য রকম করা যাবে না। অথচ…….
    অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালিয়ে চলে আসে ও সিসিডি তে । মিলি ও তুলিকা অপেক্ষা করছিল সেখানে।
    রেহান আসার পর মিলি বলে ::::;– “hallo, কেমন আছেন , ?
    রেহান ও বলে::::: ” এই তো ভালো। তুমি ভালো আছো? বলো কি খাবে? “
    মিলি –::::– আমি কিছু খাবো না গো । আমি এখন যাবো। এবার তোমরা love birds মিলে বকম বকম করো।
    বলে মিলি উঠে যায়।

    মিলি চলে যাওয়ার পর তুলিকা ওর স্বভাব মতোই নানা কথা বলতে থাকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে।দুজন আলোচনা করে খাবার অর্ডার করে।তবে এর মধ্যেও তুলিকা লক্ষ্য করে, ওর সব কথার উত্তর ই রেহান দিচ্ছে কিন্তু ও ঠিক নিজের মধ্যে নেই।
    হঠাৎ রেহান প্রশ্ন করে ::::— আচ্ছা তুলিকা ভালোবাসা সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?

    তুলিকা –::– আমার কাছে ভালোবাসা হলো commitment। ব্যাস্। আর আমি খুব practical আর বাস্তববাদী একজন মানুষ তুমি জানো এটা। লাইফ কে খুব সোজা হিসেবে দেখি। এনজয় করি। ভালো, মন্দ সবটুকু ই আমার কাছে খুব casual….. জীবন নিয়ে খুব জটিলতা আমি বুঝি না আর বুঝতে চাই ও না। খুব বেশি emotional হওয়াটা আমার দুর্বলতা ই মনে হয়। life is so simple and beautiful…

    রেহান আবার ভাবে। এগুলো যেন ঠিক ওর মনের কথা নয়।
    তুলিকা আবার ওকে জিজ্ঞেস করে.:::::… ” তুমি কি আমায় কিছু বলতে চাও রেহান? Please tell….
    একটা দীর্ঘশ্বাসকে হেসে উড়িয়ে দেয় রেহান।
    কফি শেষ করে বলে :— চলো তোমায় ড্রপ করে আমি বেরিয়ে যাবো।
    আনিকা মৃদু হেসে গাড়িতে গিয়ে ওঠে ।

    বাড়ি ফিরেও রেহান একটুও স্বস্তি বোধ করে না। ভীষণ সাফোকেটিং লাগে সবকিছু। এদিকে একবার মা, একবার বাবা, বোন ওকে পাগল করে তুলছে বিয়ের খুঁটিনাটি আয়োজন নিয়ে। এ যেন ওদের কাছে এক মহোৎসব। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা সিগারেট নিয়ে ছাদে উঠে গেল।

    পায়চারি করতে করতে মনে হলো ও অযথা বাড়ির সকলকে দোষারোপ করছে। ও পরিবারের সবচেয়ে বড়ো সন্তান। এবং সবার প্রিয়। তাই ওকে নিয়ে এই হইচই তো খুব স্বাভাবিক। সমস্ত তুতো ভাইবোনগুলো ও বারবার আসা যাওয়া করছে। কতই না জল্পনা কল্পনা তাদের।

    মনে মনে হেসে উঠলো রেহান। আর সাথেই আবারও দুটো চোখ ভেসে উঠলো ওর সামনে। তুলিকা কেও অপছন্দ করার কোনো রকম কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না ঠিকই।

    কিন্তু রেহান নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে। তুলিকার মধ্যে এমন একটা স্পার্ক আছে , একটা চৌম্বক শক্তি যাকে কোনো ভাবেই এড়ানো সম্ভব হবে না বরং দিন দিন আরও ডুবে যেতে হবে। এই বিষয়টা রেহান কে ভোগাচ্ছে।

    অন্যদিকে ওই যে বাঙ্ময় দুটো চোখের স্বর্গীয় দৃষ্টি ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যেন খোলা আকাশের নীচে একা নির্জন মাঠে দুহাত বাড়িয়ে আকুল হয়ে ডাকছে ওকে জয়ীতা। এই আকুতি, এই সমর্পণ তো সব পুরুষের কাঙ্খিত।

    কি করবে রেহান! ভীষণ শ্বাসকষ্ট হতে থাকে ওর। আর না দাঁড়িয়ে নীচে নেমে আসে ও।
    আসামাত্রই মা শুরু করে দেয়,
    দেখতো বাবু এই হারটা কি তুলিকা কে মানাবে? ও যা stylish…..
    রেহান :::: তুমি ভালোবেসে যা দেবে তাই মানাবে মা।
    বোন সুমি বলতে থাকে — দাদা,আমার কিন্তু নতুন একটা লহেঙ্গা চাই। আর একটা সেট।
    বলে ও আহ্লাদে নাচতে থাকে রেহান এর কাঁধে র উপর।
    বোন কে আলতো চাপড় দিয়ে মা বলে — এই ওকে বিরক্ত করিস না। সর তো এখান থেকে।
    কিন্তু সুমি তার দাদার গলা জড়িয়ে ঝুলতে থাকে। রেহান এর বড়ো আদরের ও।

    অনেক টা ছোটো। প্রায় দশ বছরের ছোটো বোন। বাড়িতে এই একটা মানুষ ওর চার্জার। যতো ক্লান্তই থাকুক না কেন সুমির সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি, বা গল্প, না করলে ওর একদমই ভালো লাগে না। ও সুমি কে কোলের কাছে টেনে নিল।

    খাবার টেবিলে বসে বাবা বললো —– কি রে অফিস এ ছুটি র ব্যপারটা confirmed হয়ে জানা আমাদের! বিয়ের ডেট তো ফাইনাল কিন্তু ছুটির বিষয়টা না জানতে পারলে তো বাকি সবকিছু বা তোদের হানিমুন এসবের প্ল্যান কেমন করে হবে?

    রেহান — হ্যাঁ বাবা দেখছি।

    মা এর মধ্যেই বলে ওঠে — তার উপর আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যাওয়া আছে। বিয়ের পর কিছু জায়গায় পুজো দেওয়ার আছে, বাড়িতেও একটা শান্তি স্বস্ত্যয়ন …..
    এবার রেহান ধের্য্য হারায়।

    — আহ্ মা! তোমরা এমন করছো যেন তোমাদের জীবনের এই একটাই উদ্দেশ্য। খুব বাড়াবাড়ি করছো এবার। এত্তো বেশি বেশি কোরো না please. । সময় মতো সব ঠিক ই হয়ে যাবে। পরিবেশ অন্যরকম বুঝে মা আর কথা বাড়ায় না।

    প্রতিদিন রাতেই তুলিকার সাথে কথা হয় কম বেশী । তুলিকা অদ্ভুত এক মেয়ে। সাধারণ সব মেয়েদের মতো কখনও ও একই প্রশ্ন প্রতিদিন করে না। কি খেলে, কখন ঘুমাবে, এটা কোরো না ওটা ঠিক না এমন ধরনের মাতৃত্বসুলভ আচরণ ওর একেবারেই নেই।

    ওর সাথে প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে সত্যিই রেহানের ভীষণ ভালো লাগে। একটা মেয়ে এত্তো স্বতঃস্ফূর্ত এবং যে কোনো বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন সেটা অবশ্যই শ্রদ্ধার। মোটেও একঘেয়েমি লাগে না।

    কিন্তু অপরদিকে কখনো কখনও যেন ঐ মাতৃত্বটুকু বোধহয় সব পুরুষই দিনশেষে খুঁজে বেড়ায়। তাই এই এক চিলতে ফাঁক কিছুতেই ভরাট হয়ে ওঠে না তুলিকা আর রেহানের সম্পর্কে। অর্থাৎ বন্ধন তৈরী হয় না।

    তুলিকা র সাথে সম্পর্কের শুরুটাও খুব অদ্ভুত। রেহান দের অফিসের একটা ইভেন্ট অ্যারেঞ্জ করেছিল তুলিকার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। সেখানেই আলাপ। আর সরাসরি একদিন বাড়িতেই পৌঁছে যায় তুলিকা।

    তখন রেহান বাড়িতেও ছিল না। ফিরে দেখে পুরো সবাই মিলে এক জমজমাট আসর। এটাই তুলিকার সবচেয়ে সুন্দর দিক। ও এক মুহূর্তে বদলে দিতে পারে পরিবেশ। সেদিন কারোই মনে হয় নি এই মেয়ে এই বাড়িতে একেবারে নতুন।তারপর কি থেকে কি যে হোলো দুই পরিবার কথা বলে একদম পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেললো। না বলার প্রশ্নই নেই কারণ পাত্রী হিসেবে শুধু নয় একজন মানুষ হিসেবেও তুলিকা অতুলনীয়।

    কিন্তু গত কয়েকমাসে পরিস্হিতি পরিবর্তন হয়ে গেছে জয়ীতার উপস্থিতিতে।
    এসব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে রেহান।

    এক ছুটির দিন বিকেলে রেহান দের বাড়িতে আকাশ এসে হাজির। সকাল থেকেই ভিড় বাড়িতে । তুতো ভাই বোনরা এসে হাজির কয়েকজন।আর মাত্র এক মাস বাকি বিয়ের। তোড়জোড় পড়ে গেছে যেন পুরো বাড়িতে।

    কিন্তু আকাশ এসে হইহই করে প্ল্যান করে ফেলে সবাই মিলে লং ড্রাইভ। যা ইচ্ছে খাওয়া এবং পুরো কলকাতা শহরের আশেপাশে চষে বেড়ানো। Total Hangout….. ।

    যদিও রেহান প্রথমে একটু বিরক্ত হচ্ছিলো। ভেবেছিলো ছুটির দিনটা নিজের মতো কাটাবে। কিন্তু হোলো না। তবে পরে ভাবলো – “মন্দ কি! ভাইবোনগুলো ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ওদের সাথে থাকলে মনের গুমোট টাও একটু কাটবে। “

    সুমি সহ সবাই মিলে গাড়ির মধ্যে হইহই কাণ্ড। ড্রাইভ করতে করতে অনেক দিন পর যেন রেহান ফুরফুরে অনুভূতি ফিরে পেল। এই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোর ছোঁয়ায়।

    আকাশ সামনে ওর পাশে বসে। ও এতোই প্রাণোচ্ছল যে সবার সাথে ভীষণ গল্প চলছে।

    প্রথমেই বায়না ফুচকা, চাট । রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে যখন ওরা সবাই ফুচকা ও চাট ও ঝালমুড়ি স্টলগুলোর সামনে যায় দেখে একটা স্টল এ ফুচকা ওয়ালা কে বসিয়ে রেখে জয়ীতা ওর কাজ টা করছে আর ফুচকাওয়ালা চা খাচ্ছে। রেহান এত অবাক হয় কথা বলতে ভুলে যায়।

    আকাশ ওকে দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে যায় ।
    বলে — একি জয়ীতা? তুমি এখানে?

    জয়ীতা সামান্য লজ্জা পায়।ওর ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে ওঠে নিমেষেই।

    আবার ওর সেই বিবশ করা দৃষ্টি নিয়ে পূর্ণ চোখে একবার তাকায় রেহান এর দিকে। তারপর বলে — এই স্যার, আমি একটু পাগল আছি।এরকম মাঝে মাঝে পুরো শহরের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই আর এঁদের একটু একটু পাশে থেকে ওদের ফিল করতে চেষ্টা করি।ভালো লাগে আমার।

    কোনো সমাজসেবা বা লোকদেখানো সিমপ্যাথি ভাববেন না স্যার। আমি এঁদের মধ্যেই বন্ধু খুঁজি। এদের পরিবারের কথা জানতে চেষ্টা করি। এটুকুই। কিছু করার মতো সাধ্য তো আমার নেই। তবে এঁদের সুখ, দুঃখ, ভালো লাগা মন্দ লাগা গুলো এতোটাই সরল যে গল্পগুলো যতো মলিনই হোক জটিলতার গোলকধাঁধায় অন্ধকারে ঘুরে মরতে হয় না। ভালো মন্দ সবই খুব পরিষ্কার।

    এতোটা বলে আবারও হয়তো লজ্জা পেল আর মাথাটা নীচু করলো। ততক্ষণে রেহান ও এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।জয়ীতার কথাগুলো শুনে একেবারে অন্যমনষ্ক হয়ে গেছে ও।

    আকাশ ওর মুখের অভিব্যক্তি খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু না বলে জয়ীতাকে বললো — বাহ্, শুনে খুব ভালো লাগলো যে তোমার ভাবনা গুলো আমাদের সবার থেকে একদমই আলাদা।

    কাল অফিসে তাহলে দেখা হচ্ছে কেমন?
    জয়ীতা — হ্যাঁ নিশ্চয়ই স্যার !
    ওদিকে সুমি চিৎকার করছে, — এই দাদা…..!! আকাশ দা! শিগগির এসো। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ কিন্তু!

    আকাশ জয়ীতাকে বাই করে রেহান কে প্রায় টেনেই নিয়ে এলো একপ্রকার। রেহান ও জয়ীতার মধ্যে আরো একবার শুধু দৃষ্টি বিনিময় হলো।

    ফুচকা পর্ব শেষ হলে আবার সবাই গাড়িতে গিয়ে উঠলো। সারা সন্ধে ঘুরে ফিরে , রেস্টুরেন্ট এ খেয়ে যখন ফিরলো তখন রাত সাড়ে এগারো টা। কিন্তু এই পুরোটা সময় রেহান বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল আকাশ তা খেয়াল করলো। বারকয়েক তুলিকার ফোন এলো। খুবই ক্যাজুয়াল কিছু কথা হলো। তুলিকা কেও আসতে বলা হয়েছিল কিন্তু ওর একটা জরুরী কাজ থাকায় আসতে পারেনি।

    এরপর থেকে প্রায়ই রেহান কোনো না কোনো ভাবে জয়ীতাকে অনুসরণ করে কখনও ফল সব্জির বাজারে, কখনও বেলুন ওয়ালা বা স্ট্রিট হকারদের মাঝে, কখনও বা রেলস্টেশনে বাচ্চাদের সাথে।

    নিম্নবিত্ত দের জীবনযাত্রার সাথে যেন বন্ধুর মতো মিশে যায়। জয়ীতা নিজেও এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে।
    আর এভাবেই রেহানের মনে আরও বেশি করে জায়গা করে নেয় এই মেয়েটি।

    কয়েক দিন পর অফিসে আকাশ রেহান কে চেপে ধরে…:::…. “তুই সত্যি করে বল রেহান, তুই কি জয়ীতা কে পছন্দ করিস? “

    রেহান—- ” আমি জানি না আকাশ। জয়ীতা কে তো আমি চিনতাম ই না। বিয়ে ঠিক হলো দেখেশুনে। তুলিকা যথেষ্ট ভালো মেয়ে। কিন্তু ও অন্যরকম একটু। খুব বেশি practical……. Emotions কোনো value রাখে না ওর কাছে।

    কিন্তু জয়ীতা কখনও কিচ্ছু বলে না এত শান্ত আর স্নিগ্ধ নরম ও । যেন অপাপবিদ্ধ। অথচ যার চোখের দৃষ্টি বা যে কোনো কাজে এমন একটা প্রাণ আছে যে যখন এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে আমি কিছুতেই ignore করতে পারি না। সারাক্ষণ ওর চোখ দুটো আমায় তাড়া করে। কি করি বলত?

    আকাশ —- ” তুই কথা বল না জয়ীতা র সাথে “
    রেহান—- “পাগল তুই,… কি বলব ওকে আমি? ” আর তুলিকা কেই বা কি বলব? বাড়িতে সবাই এত excited…..

    বলে ও মাথার চুল ধরে অসহায় হয়ে বলে- “কি যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না রে। দিন দিন কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে পুরো বিষয়টা। যেদিকেই যাই কোনো না কোনো একজন কষ্টে থাকবে। “

    আকাশ কিছু বলতে পারে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

    এরপর দুদিন ইচ্ছে করেই রেহান অফিসের ফিল্ড ওয়ার্ক বা আরও কিছু কাজের অজুহাতে বাইরে বাইরে কাটায়।

    এরপর যেদিন অফিসে আসে সেদিন ও ভীষণ ব্যস্ত থাকে কোনো না কোনো কাজ নিয়ে। একসময় নিজের অজান্তেই চোখ পড়ে যায় জয়ীতার দিকে । দেখে জয়ীতা ওভাবেই তাকিয়ে আছে।
    তখন হঠাৎ রেহান দেখে ফেলে ও চোখে চোখ পড়লে ও সরিয়ে নেয় ।

    এবার রেহান একটু rude হয়ে যায়। প্রচণ্ড গম্ভীর ভাবে বলে
    — জয়ীতা একটু শুনে যাও তো!
    জয়ীতা সেই কণ্ঠস্বর শুনেই হয়তো একটু কেঁপে ওঠে।

    রেহান সেই জলদগম্ভীর স্বরেই বলে চলে — “কি ব্যপার তোমার বলোতো? সবসময় এভাবে তাকাও কেন? কি চাও ? “
    জয়ীতা পূর্ণ চোখে তাকায় ।বলে —” আমি তো কিছু চাই না। “
    —- তাহলে ঐ ভাবে তাকিয়ে থাকো কেন?

    জয়ীতা কিছু না বলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

    এবার ধৈর্য চ্যুতি ঘটে রেহান এর। চীৎকার করে বলে ওঠে —-

    ” উফ্ অসহ্য লাগছে জাস্ট তোমাকে আমার। প্রতিদিন কেন এভাবে আমাকে বিড়ম্বনায় ফেল বলতে পারো? কোনো ভদ্র বা সভ্য মানুষ কি এভাবে সবসময় অন্য একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্লজ্জের মতো? কি বোঝাতে চাও আমায়? Speak up…. Please ….. “

    জয়ীতা এবারও কিছু বলে না। মাথা নিচু করে চোখে জল নিয়ে চলে যায়। পরদিন আর অফিসে আসে না। রেহান প্রচণ্ড অপরাধবোধে কষ্ট পাচ্ছিল।ভেবেছিল আজ ওকে সরি বলবে কিন্তু আকাশ বললো ও resign করেছে।

    রেহান জয়ীতাকে অন্ততঃ একবার সরি বলার জন্য অসম্ভব ছটফট করতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারে না। তখন ওর সিগারেট খাওয়া বেড়ে যায়। মেজাজ খিটখিটে। কারো ফোন ধরে না। একা একা বসে থাকে গুম হয়ে । অসহ্য যন্ত্রনায় যেন কুঁকড়ে যায়। কিভাবে পারলো ও এমন একটি নিষ্পাপ মেয়েকে এতোটা কষ্ট দিতে!

    একদিন রেহান আকাশ কে সঙ্গে করে জয়ীতার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। জয়ীতার খুব সাধারণ, সহজ সরল বাবা, মা ওদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলেন। কিন্তু কিছুতেই জয়ীতার সাথে দেখা হলো না। রেহান এর ধারণা ও ইচ্ছে করেই সামনে আসেনি।

    এবার ভেঙে পড়ে রেহান। প্রতিদিন একটু একটু করে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে ও ভেতরে ভেতরে। জয়ীতা মাত্র এ কদিনে যে মনের এতোটা জায়গা দখল করে ফেলেছে সেটা তো রেহান বুঝতেই পারেনি।

    কিন্তু এখন তো ওর সবকিছুই ভীষণ অন্ধকার লাগছে।

    ওদিকে তুলিকা বেশ কিছুদিন রেহান এর সাথে ঠিক ভাবে কথা না হওয়ায় এবং কিছুটা উদগ্রীব হয়েই একদিন চলে আসে ওদের বাড়িতে। ছুটির দিন।
    রেহান নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট টানছে । খুব অন্যমনস্ক।

    তুলিকা দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকলো।
    তুলিকা :: কি হলো ফোন ধরছো না, দেখা করছো না। are you avoiding me?
    রেহান ::::: আরে নাহ! সেরকম কিছু না। একটু ব্যস্ত ছিলাম কদিন । বোসো তুমি।
    ….. বলে উঠে বসে ও।

    তুলিকা ওর স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতেই হাসতে হাসতে বলে :::: ও তাই? আচ্ছা ঠিক আছে। আমি একটু চিন্তা করছিলাম। যদিও এই ধরনের Bad habbit আমার একদমই নেই তুমি জানো। তাই যখনই মনে হলো এবার জানা উচিত চলে এলাম।

    আচ্ছা চলো একটু বেরোই। এই কাছাকাছি কোথাও। বসি গিয়ে।

    রেহান :::; না,আজ থাক তুলিকা! আমি একটু টায়ার্ড। আর ঐ বদ্ধ রেস্টুরেন্ট বা মল এ একেবারে ভালো লাগছে না এখন।

    তুলিকা নিজের মনে একটু মৃদু হেসে বলে — আরে না না তোমায় আজ কোনো খাঁচায় বন্দী করবো না জান। ওঠো ওঠো। hurry up please….
    রেহান গড়িমসি করতে থাকে তখন তুলিকা একেবারে অন্যরকম ঠান্ডা স্বর ও স্হির দৃষ্টিতে বলে
    —– please…. ধরে নাও এটা আমার শেষ অনুরোধ।

    রেহান হঠাৎ চমকে ওঠে ::::মানে??
    তুলিকা কে এক মুহূর্তের জন্য অচেনা মনে হয় ওর।

    তবে এক লহমাতেই তুলিকা আবারও স্বমহিমায় খিলখিল করে হেসে বলে ::::: মানে তোমার মাথা।। তাড়াতাড়ি এসো আমি অপেক্ষা করছি গাড়িতে।
    রেহান আর তুলিকা এসে দাড়ায় গঙ্গার পাড়ে।

    তুলিকা বলে — বলেছিলাম না আজ খোলা আকাশ দেখাবো তোমায়!
    বলে মৃদু হাসে।

    রেহান কিছু বলে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে – সূর্য ডুবছে সেইদিকে ।
    তুলিকা পেছন থেকে এসে ওর চোখ চেপে ধরে।

    একটু বিরক্ত হয় রেহান — আহ্ তুলি! তুমি তো কখনও এমন ছেলেমানুষি করো না। please ছাড়ো।
    তুলিকা রেহান কে হাত ধরে ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। তারপর চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।

    রেহান দেখে সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে জয়ীতা। ও তো এমন বিস্মিত হয় যে কয়েক সেকেন্ড বাকরুদ্ধ থেকে যায়।
    এবারও তুলিকাই বলে — কি বলেছিলাম না। আজ খাঁচা নয়। আজ মুক্তি।
    হেসে ওঠে ও। কিন্তু এই হাসি টুকু হয়তো কান্নার অধিক।
    রেহান ওকে জড়িয়ে ধরে। চোখ দুটো জলে ভরে যায় ।

    — তুলিকা তুমি কি কষ্ট পেলে? দেখো সত্যিই আমি ইচ্ছাকৃত তোমায় বা জয়ীতা কাওকেই কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু আজ আমি অপরাধী সকলের কাছে।
    তুলিকা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। ওকে বলতে দেয়। তারপর বলে — দেখো রেহান।

    কষ্ট হচ্ছে না বা আমি কতো মহৎ, ভালোবাসার আর এক নাম ত্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি মেলোড্রামা আমার ডিকশনারিতে নেই তুমি খুব ভালো জানো। আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি। আমি লাইফ এ্য প্রত্যেক টা মুহূর্ত উপভোগ করতে চাই। ভালো, মন্দ যাই হোক না কেন।

    আমি কখনও কোনো আফসোস নিয়ে বাঁচতে চাই না। তাই ভবিষ্যৎ জানিনা। এই মুহুর্ত অবধি আমার হাতে যতটুকু আছে তা আমি অবশ্যই সদ্ব্যবহার করবো। And the real fact is you are not cup of my tea…. বুঝলে?
    রেহান তুলিকার হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে বলে —- Thanks….

    তুলিকা রেহান এর হাতে ওদের engagement ring টা দিয়ে বলে…… “”পরিয়ে দাও ওকে””…. আর হ্যাঁ কষ্ট আমার অবশ্যই হচ্ছে। সেটা অস্বীকার করলে তোমায় অস্বীকার করা হয়। তবে এটাও আমার ভালো লাগাই। তোমার সাথে প্রতি মুহূর্ত আমি এনজয় করেছি। আজ ও করছি। so this is the part and parcel of life….. Just move on….

    রেহান চোখে জল নিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে অদ্ভুত ভাবে তাকায়।

    তুলিকা বলে ,— “আমি কোনো magician না রেহান। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা কিন্তু ভীষণ পিওর। তবে আমি বাস্তবতা খুব বেশি বুঝি। আকাশ আমায় সব বলেছে। ভালো থেকো তোমরা ।
    বলে জয়ীতার পিঠে হাত রাখে।
    চলে যেতে যেতে আবারও বলে —
    বাকি সব দিক ….. (হেসে) I’ll manage…… Don’t worry about that….. রেহান।
    তুলিকা চলে যায়।
    জয়ীতা এতক্ষণ মাথা নীচু করে শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

    এগিয়ে এসে রেহান জয়ীতাকে ধরে ওর মুখটা হাতের মধ্যে তুলে দেখে ওর মুখটা চোখের জলে ভেসে গেছে।
    ও আলতো করে মুছিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। কিছু মুহূর্ত সব ভুলে যায় ওরা।

    একটু পরে রেহান বলে —-” এভাবেও জয় করা সম্ভব? উম্? পাগলি একটা। তুমি কেমন করে শুধু চোখের ভাষায় আমার পুরো মন জুড়ে রাজত্ব গড়ে ফেললে বলোতো!! কিভাবে পারো এতো ইমোশনস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে? আমার তো মনে হয় রাস্তার ধুলোর কণা গুলোও বোধহয় তোমায় ভালোবাসে। “

    রেহানের বুকের সাথে মুখ গুঁজে একদম মিশে থাকে জয়ীতা। কোনো কথা বলে না।

    রেহান আবার বলে — খুব কষ্ট পেয়েছো সেদিন না!? I’m extremely sorry জয়ীতা। আমায় ক্ষমা করো। আসলে আমি ভীষণ কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। কি করবো না করবো এসব ভেবে।

    জয়ীতার মুখ টা আবারও তুলে ধরে ও।
    — কি, একটাও কথা বলবে না?
    জয়ীতা এবার অস্ফুটে বলে —

    আমি খুব সাধারণ স্যার। আপনি অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আর আমার স্ট্যাটাস তো আপনি জানেনই। তাছাড়া আমার অদ্ভুত সব অভ্যেস। এসব হয়তো আপনার পরিবার মেনে নেবে না।

    রেহান মাথা ঝাঁকিয়ে জয়ীতার কাঁধটা হাল্কা করে ধরে বলে— কি পাগলী তুমি বলোতো! আমিও এই সাধারণ মেয়েটাকেই খুব ভালোবাসি জয়ীতা। খুব সাধারণ হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন পৃথিবীতে।

    আর তোমার যে সব অদ্ভুত অভ্যেস তা আমার কাছে গর্বের। আর আমার পরিবারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার সুখ। তারা তোমায় হয়তো আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। আর তুমি কি আমায় স্যার ডাকবে এখনও?

    দুজনেই হেসে ফেলে।
    এরপর ঠিক যখন সন্ধ্যা নামছে তখন আঙটি পরিয়ে দেয় রেহান জয়ীতাকে ।

    জয়ীতা এখনও জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নীচু। চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। ছোট ছোট হেঁচকি উঠে মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে।

    রেহান ওকে ছোটো বাচ্চাদের মতো আগলে ধরে।কপালে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে ছোট্ট নরম চুমু এঁকে দেয়।পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছিয়ে দেয় চোখমুখ। জলের বোতল কিনে আনে একটা। জয়ীতা জল খায় আর চোখমুখ ধুয়ে নেয়।

    রেহান বলে —-

    চলো না বসি আমরা একটু এখানে ।কত সুন্দর হাওয়া।জয়ীতার হাত ধরে নদীর পাড়ে বাঁধাই করা জায়গাটার এসে বসে রেহান।হাতটা মুঠোয় ধরে থাকে। কিছুক্ষণ পর আলতো করে

    জয়ীতার মাথাটা ওর কাঁধে টেনে আনে । জয়ীতার চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে রেহানের চোখেমুখে লাগে। রেহান আলতো করে সেগুলো গুছিয়ে হাত বুলিয়ে দেয় জয়ীতার মাথায়। কোনো কথা হয় না।

    অথচ মুঠোবন্দী আঙুল,একে অপরের স্পর্শ যেন অজস্র কথা বলে চলে।যেন বহু বহুযুগ ধরে এই বিন্দুতেই ওদের চাওয়া আর পাওয়ার গন্তব্য। এই বিন্দু টেনেই বৃত্ত হবে ওরা। আর ওই বৃত্তেই আবর্তিত হবে ওদের এক পৃথিবী ভালোবাসা।

    লেখক: কবি, কথা সাহিত্যিক, গায়িকা ও শিক্ষিকা

    প্রতি মুহূর্তের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের Google News, Facebook, Twitter, Linkedin এবং Instagram পেজ

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img