আশফাক অনুপ
অধ্যাপক রিচার্ড ইটন তাঁর “রাইজ অব ইসলাম এন্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার” গবেষণা গ্রন্থে আমাদের যে উপলব্ধিটির সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন তাহলো- খুব সক্রিয় ব্রাহ্মণ্যবাদি অনাচারের সন্মুখিন না হয়েও পূর্ববাংলার বিরাট কৃষিভিত্তিক জনসমাজ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। ব্রিটিশদের জনগণনার পূর্বে এসত্য কেউ জানতোও না।
এটার কারণ হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘকাল যাবত উৎপাদন ব্যবস্থার সবথেকে সক্রিয় অংশ হওয়া সত্তেও তাদের নিজেদের সামাজিক মর্যাদার অবমূল্যায়ন। সমাজের যে গ্রহণযোগ্য রুচীর সংগা, সেখানে ভূমিজ মানুষের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে অন্য কোনো সংস্কৃতিকে উঁচুদরে বসতে দেখে তারা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির স্বার্থে দরকারে অপর কোনো বহিরাগত সাংস্কৃতিক অস্ত্রকে আত্মীকরণ করেছে। এটাকে অভিমান না বলে প্র্যাগমাটিজম বা বাস্তববাদিতা বলা যেতে পারে।
কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় রাখা জরুরি যে, যদি কোনো সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূ-রাজনৈতিক চাপ বা ভীতির সন্মূখিন না হয়, তাহলে ব্যক্তি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তনের পেছনে কেবল বাস্তব/প্রাগমেটিক কারণ না বরং কিছু আত্মীক/ স্পিরিচুয়াল কারণও থাকে। সেখানেই হাত বাড়িয়েছে বাঙালির ভূমিজ সংস্কৃতি।
আজকাল বাঙলার ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি নিয়ে ধর্মীয় কারণে যাদের গা চুলকাচ্ছে, তাদের প্রতি অনুরোধ- চোখের সামনে পৃথিবীর ম্যাপটা খুলে বসেন। দেখেন ভৌগলিকভাবে পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশের সাথে লাগোয়া আরেকটা প্রতিবেশী মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশ আছে।
পৃথিবীর অর্ধশত মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে বাংলাদেশ, যার সাথে ভৌগলিকভাবে আর কোনো মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশের সংযোগ নাই। এইযে, একদম সংযোগ বিচ্ছিন্ন একটা ভূখন্ডে এতো মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন- সেটার ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন সার্বিক দিক মাথায় রেখে। তবেই পরিষ্কার বুঝতে পারবেন- ইসলাম এই ভুখন্ডে এসেছে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে।
গোটা পৃথিবীতে বাঙালি মুসলমানই একমাত্র মুসলমান গোষ্ঠী যারা মূলত হৃদয়ের টানে মুসলমান হয়েছেন, ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বাধ্য হয়ে না। তাই তারা যতটা মুসলমান, তারচে একটুও কম বাঙালি না। সুফি ঘরাণার অসংখ্য আউলিয়াগণ এসেছেন এই বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডে, মানুষকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন পুঁথির মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে, সুরের মাধ্যমে।
মধ্যযুগের রবীন্দ্রনাথ হিসেবে খ্যাত মহাকবি আলাওল, আব্দুল হাকিম, সৈয়দ সুলতানের মতো অসংখ্য মানুষের রচিত অসংখ্য সুর, কথা, গান, পুঁথি না থাকলে আজকে আপনি যে বিরাট মুসলমান পরিচয়ে গর্ব করেন সেই পরিচয়টাই আপনার পূর্বপুরুষগণ গ্রহণের সুযোগ পেতেন না। তাই নিজের সেই সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে আজেবাজে কথা বলে নিজের অশিক্ষার প্রমাণ দিয়েন না যেখানে সেখানে।
[উল্লখ্যঃ সময় ও কলেবর সংক্ষেপনে বেশকিছু প্রামাণ্য বক্তব্যের ব্যাপারে বিষদ আলোকপাত করা যায়নি। কেউ আলোচনায় আগ্রহী হলে ইমেল করুন ashfaque.anup@gmail.com]
বি:দ্র: মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত কলামের দায়-দ্বায়িত্ব লেখকের। প্রভাতী সংবাদ কর্তৃপক্ষ কোন দায় বহন করবে না।