অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক:
পবিত্র মাহে রমজানের সমাপনী দশক আমরা অতিক্রম করে চলেছি। আজ ২৩ রমজান। এ পবিত্র মাসে হালাল পানাহারের পাশাপাশি অপচয় রোধপূর্বক এক পরিচ্ছন্ন জীবনবোধে উজ্জীবিত হওয়া দরকার। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার নামে, ইফতারের নামে কিংবা ঈদ বাজারের নামে আমাদের অপচয়ের অন্ত নেই। এর পরিণাম কিন্তু কখনও শুভ হয় না।
রেডিও বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে একবার একটা সুন্দর কাহিনী প্রচার করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, এক দেশের রাজাকে নাকি কয়েক বছর দেশ শাসন ও পরিচালনার পর নির্বাসন দেয়া হতো। এটা দেশটির রীতি। কেউ ক্ষমতায় বসলেই এক পর্যায়ে তাকে নির্বাসিত জীবন বরণ করে নিতে হবে। এভাবে অনেক রাজা নির্বাসিত অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করে মারা যান।
কারণ, এক সময় এসব ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী হলেও নির্বাসিত জীবনে তারা এসব উপভোগ করতে পারেন না। কিন্তু একজন রাজা ছিলেন বড় মিতব্যয়ী এবং নিজের পরিমাণ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। তিনি নিজের শাসনামলে যে পরিমাণ নিজের সামর্থ্যে কুলায় নির্বাসনের স্থানে গোপনে মাল সামগ্রী জমা করতে থাকেন।
যখনই তার নির্বাসন জীবন শুরু হলো তিনি কোন প্রকার দুশ্চিন্তা ছাড়াই তা গ্রহণ করেন এবং সঞ্চিত মালের ওপর নির্ভর করে স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপন করে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। সুখ বিলাসিতার দিনে নিজের দুঃখের দিনগুলোর কথা স্মরণে ছিল বলেই তিনি খুব সহজেই তার যাতনার জীবন মোকাবেলায় সক্ষম হন।
এভাবেই পরিণামদর্শীরা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে সমর্থ হয়। পক্ষান্তরে নেয় না, চলে না হিসেব করে তারা নিমজ্জিত হয় দুঃখ-কষ্টের অতল সাগরে। মিতব্যয়িতা মানব জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় যা কিনা মানুষকে দিতে পারে ভবিষ্যত স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাবলম্বী জীবনের নিশ্চয়তা।
মানুষ যে যে স্তরেরই হোক না কেন, এ অভ্যাস সকলকেই পরনির্ভরশীল থেকে মুক্ত রাখতে পারে। ব্যক্তিজীবনে যদি মিতব্যয়ী হওয়া যায় তাহলে ব্যক্তিজীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। চাঁদ যেমন দৃশ্যতঃ পনেরো দিন আলো আর পনেরো দিন আঁধার, নদীতে যেমন আছে জোয়ার-ভাটার প্রাকৃতিক নিয়ম, মানব জীবনেও আছে সুখের পর দুঃখ কিংবা দুঃখের পরে সুখ।
প্রত্যেককে জীবনের সে তারতম্যটুকু খুঁটিয়ে বের করতে হবে এবং সে মতে পুরো জীবনে একটা সামঞ্জস্য বিধানে ব্রতী হতে হবে। মহান আল্লাহ পাক তো সাফ বলে দিয়েছেন, যে জাতি নিজেরা নিজেদের ভাগ্য বিনির্মাণে অগ্রসর না হয় আল্লাহ তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। তাই ইনকাম যদি পর্যাপ্ত হয় তা এমনভাবে সংযত ব্যয় করা উচিত, আগামীতে কোন অসুবিধায় পড়লেও যেন সঞ্চয়ী অর্থ-সম্পদ থেকে তা কাটিয়ে ওঠা যায়।
সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন হলে সীমিত আয়ের অধিকারী হয়েও সুন্দর আগামীর স্বপ্ন আঁকা যায়। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক হাহাকারের যুগে এ ব্যাপারে প্রতিটি দেশ ও সমাজের মানুষকে সচেতন হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা, আয়-উপার্জনের ক্ষেত্র, সাহায্য-সহযোগিতার স্থান ও পারস্পরিক সহমর্মিতা এক রকম উধাও হয়ে যাচ্ছে।
অপর পক্ষে ব্যয়-অপচয়ের ছিদ্র, দুর্যোগের ঘনঘটা বেড়েছে অসংখ্য-অগণিত পথে। এমতাবস্থায় অপব্যয় ও অপচয়রোধ মিতব্যয়িতার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে সকলকে। আমাদের জাতীয় জীবনেও মিতব্যয়িতার চর্চা খাটো করে দেখার জো নেই। দেশের যারা কর্ণধার হয়ে বসেন তাদের ভোগ বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা অনেক ক্ষেত্রে নিতান্ত জাতীয় স্বার্থের জলাঞ্জলি, অপব্যয় বৈ কিছু নয়। অথচ সরকারী আমলা অফিসারগণ জনগণের আদর্শিক মডেল।
ব্যক্তিজীবন, দাম্পত্য জীবন, সমাজ জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত আমাদের অপচয়, অপব্যয় ইত্যাদি পরিহারের মনমানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। তবেই এ জাতি দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত হতে সক্ষম হবে। এটা যত দ্রুত অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল। কালী প্রসন্ন ঘোষ সুন্দর করে বলেছেন, যে জীবনের প্রথম থেকে মিতব্যয়ী হতে না শিখে, তাহার নিকট স্বদেশ, স্বজাতি অথবা সমাজ, তাহাদের কোন প্রত্যাশা নাই।’
এ কথা সত্য যে, ধনী গরিব নির্বিশেষে আমরা অনেকেই কোন না কোন অপ্রয়োজনীয় কাজে এমন কিছু অর্থ ব্যয় করি যা অনায়াসেই সঞ্চয় করা যায়। হোক না সে সঞ্চয় ক্ষুদ্র, নিজের ভবিষ্যত ও জাতীয় অগ্রগতির জন্য খুবই মূল্যবান। আমাদের যা কিছু সীমিত সম্পদ, দেশের উন্নয়ন কর্মসূচী পরিচালনার জন্য তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার প্রয়োজন।
লক্ষ্যণীয়, আমরা যদি কাজ শেষে পানির কল ও গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখি, বিনা প্রয়োজনে বিদ্যুতের বাতি জ্বালিয়ে না রাখি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, অট্টালিকা, গাড়ি, যানবাহন, কারখানার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ঠিক সময় মতো মেরামত করি, বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় না করি তাহলে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ বেঁচে যায়।
আল কোরানের বিভিন্ন স্থানে অপচয়কারীদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে এবং এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য তাগিদ ও উৎসাহ দেয়া হয়েছে। সুরা আরাফের ৪১নং আয়াতে বলা হয়েছে, কুলু ওয়াশারাবু ওয়ালা তুসরিফু ইন্নাল্লাহা লা-ইউহিবুল মূসরিকীন- ‘তোমরা খাও এবং পান করো, তবে অপচয় করো না। কেন না আল্লাহ কখনও অপচয়কারীদের ভালবাসেন না।’ মহানবী (স) এর একটি বহুল আলোচিত হাদিস শরীফ এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি এরশাদ করেছেন- মিতব্যয় জীবিকার অর্ধেক এবং উত্তম প্রশ্ন শিক্ষার অর্ধেক।’
সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ, প্রকাশিত-২৫/৪/২০২২