ফারজানা রহমান, এ্যানি:
মানুষ মানুষের মধ্যে এত বিভেদ সৃষ্টি করে কেন ছেলেটা এত আনন্দ উপভোগ করে তা কোনদিন বুঝতে পারলো না মিথিলা।
রাতুল সব মিলিয়ে অসাধারণ একজন মানুষ । শুধু দোষ একটাই কারো মিল মহব্বত দেখলেই তার অদ্ভুত এই খেলা তার উপর চালিয়ে দেবে। ও বলে মানুষ মনে এবং মুখে কখনো এক হয় না।
যদিও ওর এই কথা ও নিরানব্বই ভাগ সত্য বলে প্রমাণ করে দেখিয়েছে। তবুও মানুষের বিশ্বাস নিয়ে এই খেলা মিথিলার পছন্দ না।
সাজন ওদের বন্ধু, সেই ছোট বেলা থেকে। এক পাড়ায় হেসে খেলে বেড়ে উঠা। ও মানুষের কাছে আসতো ততটাই সে মানুষটি কে নানা অজুহাতে বিব্রত করতো।
কোন কারণ ছাড়াই সে এর ওর নামে গুজব ছড়াতো। নিজের জীবন নিয়ে নানা রহস্য তৈরি করে সব সময় আলোচনায় অংশ হয়ে উঠতো।
অথচ ভালোবাসার বিষয়ে সে ছিল পাক্কা জহুরী। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ,ভদ্র আর একটু গোছানো পারিবারিক ভাবে বিত্তশালী পরিবারের সদস্য রাইনাকে কেমন করে ভালোবাসার মায়াজালে জড়িয়ে বিয়ে করে ফেললো। তার থেকে ও বড় সত্য দিব্বি লক্ষ্মীমন্ত স্বামীর আচরণ করে জীবন যাপন করতো নিজের খেয়াল খুশি মত।
কত যে নারী তার এই মোহিত আচরণে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতো তার কোন হিসেব নেই। অথচ আপদ মস্তকে সাজন একজন স্বৎজন পুরুষ বলে পরিচিত ছিল সবার কাছে।
কেউ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারবে না ওর এই নিপাট ভদ্রলোক আচরণের পিছনে কি নোংরা একটা মানুষ বাস করে।
রাতুল ওর ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে এখন । মিথিলা ওর পরিচালিত সেবাশ্রম দেখা শোনা শেষে প্রায় রাতুল ছড়া চা বাগানের পথে হাঁটতে আসে আজকাল। সংসারে তেমন কেউ না থাকাতে সুযোগ হলে রাতুলের বাড়িতে উকি দিয়ে খোঁজ খবর নেই বাল্য বন্ধুর আর মায়ার মায়াভরা যত্নের তৈরি নানা খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরে। মায়া আশ্চর্য এক নারী।
স্বামীর বাল্য বন্ধুর পছন্দের খাবারের তালিকা ওর এর পঁচিশ বছরে এমদম ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে। মিথিলা অবাক হয় ওর করিৎকর্মা এই সদা হাস্যোজ্জ্বল আচরণ দেখে। তাই এখন রাতুল থেকে মিথিলার সাথে মায়ার বলতে গেলে বন্ধুত্ব অনেক বেশি!
ইদানিং মিথিলা খেয়াল করেছে সাজন বেশ কয়েকজন নারীর সাথে খুব যত্নে একটা সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এদের কারো সাথে মজা করে রসের কথা বলে আবার কারো সাথে থেকে বিপদ থেকে রক্ষা করে যেন সত্যি তার প্রতি সে অনুরক্ত।
রাইনা এসব বুঝতে পারে হয়তো কিন্তু এত বছরের ভালোবাসার মায়াজালে বিভোর হয়ে হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে তোর কোথাও ভুল হচ্ছে রে মিথিলা, ও তো এমন নয় ।
ওরা সাজনের কাছে নানা সহযোগিতা নিতে আসে এর বেশি কিছু নয়। তুই তো সারা জীবন এই পাঠ চুকালিনা তাই তোর কাছে এমন মনে হচ্ছে। সংসারে যোগ মিলাতে অনেক সময় দুই দুই এ পাঁচ বলতে হয় রে বোকা!
স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস দেখে মিথিলা সত্যি আবার নতুন করে ভাবতে বসে হয়তো তাই হবে। রাইনার মত এত ভাল একটা মেয়েকে সাজন কেন ঠকাতে যাবে? আর ভাবে ওর আশেপাশের সবাই খুব ভাল থাকুক।
রাতুল সুযোগ পেলে মিথিলাকে নানা ভাবে সেবাশ্রম পরিচালনা করতে সাহায্য করে । পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে মিথিলা এখন পুরোপুরি ওর এই কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
সেদিন ছিল মাঘিপূণিমা । মায়া বিকালে খবর পাঠিয়েছে ওদের পাশের বাসার রমাকে দিয়ে আজ যেন মিথিলা রাতে ওদের ওখানে খেতে যাই। রাতুল গতকাল শ্রীমঙ্গল থেকে দুটো রাজহাঁস এনেছে, সাথে সাতকরা।
মায়া চালের আটার রুটি তৈরি করে সেই রাজহাঁস সাতকরা দিয়ে রান্না করে ছাদে শীতল পাটি বিছিয়ে দুই বন্ধুকে খাওয়াবে। রাতুলের যদি মন ভাল থাকে তবে গানের আসর জমে যাবে।
রাত বেশি হয়েছিল বলে রাতুল মিথিলাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাথে গিয়েছিল। দুই বন্ধুর একথা সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ রাতুলে মিথিলার সাথে বাজি ধরে সেই খেলা শুরু করেছিল সাজনকে নিয়ে।
তবে তা হবে রাইনার সাথে। সাজনের প্রেমে অন্ধ রাইনা না বুঝেই রাতুলের এই খেলায় যোগ দিয়ে দিলো।তার ফলাফল এত ভয়াবহ হবে রাতুল তা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি!
কয়েক মাস পর খুব সকালে রাতুলের ডাকা ডাকিতে মিথিলা ঘুম চোখে ঘরের বাহিরে আসলো। রাতুল অঝোর ধারায় কাঁদছে আর বলছে আমি এটা কি করলাম! আল্লাহ আমাকে মাফ করে দেও।আমি কখনো চাইনি এমন হোক রাইনা এভাবে মারা যাক।
তুই বল মিথিলা আমিতো শুধু মজা করে রাইনাকে বলেছিলাম ভাবি সাহেবকে একটু নজরে রাইখেন। তার ফলাফল দেখ রাইনা আমাকে এই চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছে গত রাতে। আমি নিজেও তো এই চিঠি পড়ে হতবাক হয়েছি।
চিঠিতে শুধু এতটুকু লেখা
রাতুল ভাই,
আমি আমার এই জীবনটাকে উৎসর্গ করে গেলাম এক ভন্ড বহুরুপী আপাদমস্তক একজন অমানুষের জন্য। এই পৃথিবীতে আমার আর কোন চাওয়া নেই। সব নিঃশেষ করে দিয়েছে সাজন..
ইতি
রাইনা
লেখক: কবি, কথা সাহিত্যিক ও উন্নয়ন কর্মী