রিপন চৌধুরী:
সাহিত্যের আদিমতম একটি শাখা কবিতা । মানুষ তার মনের ভেতরের যে কোনো চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতিগুলো যখন ছন্দ, রূপ, রস, অলংকারে প্রকাশ করে তখনই সেসব হয়ে ওঠে কবিতা। ওয়াডর্সওয়ার্থ বলেছেন, জীবনের সত্য ও সৌন্দর্যের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনোপলব্ধির সমালোচনাই কবিতা। কবি শেলী বলেছেন, ‘কল্পনার অভিব্যক্তিই হলো কবিতা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘উপমাই কবিত্ব’। এই উপমা কোন ধরনের উপমা? যে উপমায় থাকবে মুগ্ধ হওয়ার উপকরণ, যার নাম সৌন্দর্য।
কবি শামীমা নাইস তাঁর “নিমগ্ন প্রার্থনায় তুমি” কাব্য গ্রন্থে সুদৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন ‘কবিতাতেই আমার আজন্ম বসবাস’; গ্রন্থবদ্ধ আটষট্টিটি কবিতায় এই উচ্চারণের যথার্থতা স্পষ্ট। শামীমা নাইস’র কবিতা সহজ সরল ও সাবলীল উচ্চারণে গভীর বোধের কথা বলে। লেখার স্বতঃম্ফূর্ততা তাঁর রচনাকে সুখপাঠ্য করে তোলে। শামীমা নাইস সে কাজটিই সুনিপুণ ভাবে করেছেন। তাঁর কবিতা ব্যক্তিগত দুঃখ-সুখ, আনন্দ- উচ্ছ্বাস, মানবীয় প্রেম প্রকৃতির সৌন্দর্যের মূর্ত-বিমূর্ত কাব্যিক ব্যঞ্জনায় ভরপুর; প্রত্যেক ব্যক্তির অনুভূতির সঙ্গেই সাধারণত মিলে যায় I একজন লেখক যখন পাঠকের বোধের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন, সেটিই তার সার্থকতা ।
“সাদা মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যায়
উদাসী গাঙচিল
ডানা ঝাপটানো প্রেমে
খুঁজে ফিরে স্বপ্নের মিল।
নিঃস্ব রিক্ত হৃদয়ে
সীমাহীন কষ্ট সয়ে
আলোহীন পথ পেরিয়ে
ঋণহীন ভালোবেসে
উড়ে চলে উড়ে চলে
সবুজ সকালের হাতছানিতে।”
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘অবসেশন পিরিয়ড’ বা ঘোর লাগা সময়। শামীমা নাইস নিপুণ শব্দের মাধ্যমে প্রেমের অবসেশন সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
নিজেদের প্রজাতি বলে আমরা মানুষকেই সবার উপরে রাখি এবং এই স্বঘোষিত সর্বোচ্চ আসন নিয়ে যুক্তিবাদী ও সংশয়বাদীরাও দ্বিমত করেন না। কবি শামীমা নাইস কাব্যিক অলংকারে নানন্দিকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি পাখিদের মাঝে দেখেছেন সাম্য মৈত্রী আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। তাই তিনি লিখেছেন পাখিদের কাছ থেকে মানুষের নিতে হবে মানবীয় মানবিক পাঠ । যাপিত জীবনের চারপাশ সুক্ষ্ম দ্বান্দ্বিকতার প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কবিতার উপজীব্য তৈরী করে উপস্থাপন করাই কবির কাজ।কবিতায় কবির অভিপ্সা, মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শিখুক, আমি মানুষ, মনুষ্যত্বই আমার ধর্ম।
“আকাশ জুড়ে মেঘের আর্তনাদ
পাহাড় ঘেঁষে আঁধার নেমেছে আজ।
দমকে দমকে বয়ে চলেছে
উদাসী ব্যাকুল হাওয়া-
স্রোতের প্রতিকুলে তবু
মাঝির বৈঠা বাওয়া।
মেঘের সঙ্গে আজ পাহাড়ের কথকতা
একা বারান্দায় কিশোরীর মন খারাপের বার্তা।
অভিসারী মন তার খুঁজে ফিরে
এক মুঠো লাল ভালোবাসা-
হলুদ অন্ধকার ছেনে নিবে সে
সবটুকু সবুজ মায়া।”
কবিরা যখন মানুষের জীবন, স্বপ্ন, আশা আর আশাভঙ্গের বিবরণভাষ্য নির্মাণ করেন কবিতায় শব্দের নিঁখুত বুননে–সেই কবিতায় যে শরীর নির্মাণ হয় সেই শরীরে গেঁথে থাকে মানবেতিহাস, দ্রোহ, প্রেম, বিরহ, কষ্ট, যন্ত্রণা, নদী, ফুল, পাখি, প্রকৃতি, রিরংসা, সমাজ, সংস্কৃতি, পুঁজিবাদ, নিপীড়ন, শোষণ ও জীবন বোধের নানান অনুষঙ্গ।কবি শামীমা নাইস তাঁর কাব্য গ্রন্থে প্রথম কবিতায় শেষ তিন লাইনে বলেছেন,
“তোমার হৃদয়ের নীল সরোবরে নিশ্চুপ ডুব দিয়ে
সাদা অপরাজিতার মতো হাসি,
অনুপম অনুভবে সুখের সাগরে ভাসি। “
আজকের এই সময়ে, যখন ধার্মিকেরা অধার্মিক আর রক্ষকেরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন কবি তাঁর “আলোর চোখে চোখ রাখি” কবিতায় উচ্চারণ করেন,
“সাম্য মৈত্রী মানবতার চেতনায়
আলো জ্বেলে, শান্তির পায়রা উড়িয়ে
আমি সমতার মিছিলে আওয়াজ তুলি-
পূঁজিবাদ নিপাত যাক, ধ্বংস হোক যুদ্ধবাজ।”
ভারতবর্ষ দীর্ঘ দিন ধরে ফর্সা বর্ণের আর্য, মুঘল এবং সবশেষে ব্রিটিশদের শাসনে ছিল। এ কারণে ফর্সা রঙটি সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে, এই ঔপনিবেশিক মানসিকতার ব্যথিত হয়ে কবি তাঁর কবিতায় বলেন,
“ভালোবাসা পেলে
কালো মেয়ে ভুবনটাকে আলো করে
অপরাজিতা হয়ে ফোটে।”
তাঁর কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য, রূপব্যঞ্জনা বর্ণনারীতি ও আধুনিক রূপায়ণ কবিতাকে করে তুলেছে দ্যুতিময়, সৌন্দর্যস্নাত।প্রতিটি কবিতা জীবনের খুব কাছাকাছি থেকে নেয়া। কবির এ কাব্যভাবনা কতটা শক্তিশালী, কতটা ব্যক্তি মনস্তত্ত্বকে ছুঁতে পারলো তা কবিতাপ্রেমী পাঠকই বিবেচনা করবেন।
“তোমার পাঠানো উদাসী দখিন হাওয়া
শরীরে মাখবো ভেবে
এলোচুলে দাঁড়িয়ে থাকি খোলা মাঠে একা
মনের দরোজা জানালা খুলে দিই
মুছে দেই সীমান্ত রেখা;
উপড়ে ফেলি নিন্দার কাঁটা
মেঘের কোলে বৃষ্টি হাসে
প্রেমের জোয়ারে ভাসে সৃষ্টিকুল।
ঘাসে ঘাসে ভেজা বৃষ্টিতে তুমি এলে
সর্ষে ফুলের ঘ্রাণে, দুচোখের আলিঙ্গনে
দুজনে ভিজে ভিজে স্নিগ্ধ মায়ায়, নিয়ন আলোয়
হেঁটে যাই শহরের অলি গলি রাজপথ।”
এবছর ২০২২ সালের একুশে বই মেলা উপলক্ষে “নিমগ্ন প্রার্থনায় তুমি” কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে প্রান্ত প্রকাশন; পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০, মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকা। বইটি ঢাকায় বাংলা একাডেমি একুশে বই মেলায় স্টল # ১০৩-১০৪, প্রান্ত প্রকাশনে পাওয়া যাচ্ছে l “নিমগ্ন প্রার্থনায় তুমি” ‘কাব্য গ্রন্থটির পাঠক প্রিয়তা প্রত্যাশা করছি l
লেখক: সম্পাদক ও গবেষক