More

    নিকোলাই গোগলের ওভারকোট: পাঠ প্রতিক্রিয়া

    মাসুদ পারভেজ:

    জন্মগত এক কেরানী ও তার সাথে ঘটে যাওয়া নিদারুণ ও সরস এক আখ্যান ওভারকোট । আকাকি আকাকিয়েভিচ, জন্মের পরে যার জন্য যুতসই নাম না পাওয়া যাওয়াতে শেষ অবধি তার নাম রাখা হয়েছিল বাপের নামানুসারে। যার জন্ম হয়েছিল কেরাণী হওয়ার জন্য, অফিসে মনোযোগের সাথে কাজ করে সহকর্মীদের কথা শুনার জন্য। অফিসে আকাকি আকাকিয়েভিচের বেশ সুনাম। কেউ কেউ অবজ্ঞা করলেও অফিসের বড় বস আকাকি আকাকিয়েভিচের কাজের প্রতি নিষ্ঠতা দেখে তাকে নতুত্ন কাজের দায়িত্ব দেন । কিন্তু আকাকি আকাকিয়েভিচ শুধু নকলনবিসের কাজই ভালো পারে। সহকর্মীদের নানা বাঙ্গাত্নক কথা স্বত্তেও কখনোই কাজে ভুল হয় না, অফিস কামাই করে না । অফিসের বড় স্যারের দেওয়া নতুন কাজ ভালো লাগে না। ফলে, শুধুই নকলনবিস হিসেবেই দিন চলে যাচ্ছিল আকাকি আকাকিয়েভিচের।

    পেশায় কেরাণী তার উপর কমতি কামাই, এই সময় শৈত্য প্রবাহে আকাকি আকাকিয়েভিচ কাবু হয়ে যাচ্ছিল। ছেড়া ও ক্ষয়ে যাএয়া ওভারকোট জনিত কারণে। যা নিয়ে অফিসের সবাই নিত্য হাসাহাসি করে। দারোয়ান থেকে শুরু করে পদস্থ সবাই এই অচল ওভারকোট নিয়ে মজা করতে ছাড়ে না। কিন্তু আকাকি আকাকিয়েভিচ নিরুপায় প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ তাকে কাবু করলেও ওভারকোট নতুন কেনার সামর্থ্য তার নেই।

    সাইনবোর্ডবিহীন দর্জি পেত্রোভিচ। কাজ ভালো হলেও মদের নেশায় চুর থেকে খদ্দেরকে কম দামে কাজ করে দেয়; পেত্রোভিচের বউয়ের এই অভিযোগ অনেক পুরাতন। পেত্রোভিচ মনে করে তার কাজ আক্ষরিক অর্থে ভালো। সাইনবোর্ড না থাকার দরুণ তার কাজের প্রসার হচ্ছে না। এমনতর এক সময়, যখন বউ রান্নাঘরে কাজ করছিল আর পেত্রোভিচ আপনমনে বিড়বিড় করতে কি জানি দেখছিল কিংবা করতে ব্যস্ত ছিল ; আকাকি আকাকিয়েভিচ সে সময়ে পদার্পণ করেছিল তার ক্ষয়ে যাওয়া ও অচল ওভারকোট ঘাড়ে নিয়ে। পেত্রোভিচ ভ্রু কুচকানোর আগেই বললো, এটা ঠিক করে দাও। এ জন্য আকাকি আকাকিয়েভিচ ভাবলো দাম কত নিতে পারে। দুই-চার রুবল সে ঠিক করে নিল। পেত্রোভিচ তার জহুরি চোখ দিয়ে আগাগোড়া একবার দেখে বললো ; হবে না। হবে না মানে কি এই প্রশ্নের জবাব আবার দিল ; হবে না।

    পেত্রোভিচ এই কথা বলবে তা ঘূনাক্ষরেও ভাবে নি আকাকি আকাকিয়েভিচ। এ যেন অতলে হারিয়ে ফেলা নিজেকে। প্রচন্ড ঝড়-ঝঞ্ঝার হঠাৎ মুখোমুখি হওয়া। এমনিতেই তার কামাই দিয়ে চলে না। তার উপর একটা ওভারকোটের টাকা যোগাড় করা তার সাত জনমেও হওয়ার নয়।

    ভগ্নমনোরথ নিয়ে তার পরের দিন অফিসে গেল আকাকি আকাকিয়েভিচ। ভাবলো আসন্ন বোনাস বেশি দিলেও তো একটা ওভারকোটের টাকা হবে না। এমনকি তার মাসের শুরুতে জমানো কোপেক বের করলেও হবে না। হলেও দুই মিলিয়ে আধেক হবে। এই অকুলপাথার ভাবতে ভাবতে পেত্রোভিচে শরণ হলো বেশ ক’বার। একটা ওভারকোটের প্রয়োজন কোনভাবেই হেলা করার নয়।

    আকাকি আকাকিয়েভিচের ভাগ্যাকাশে নতুন শুকতারা উদিত হওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেল বোনাস ৬০ রুবল পেয়ে। এ একেবারে অপ্রত্যাশিত। এবার সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ওভারকোট বানাবেই। পাকা দর্জি পেত্রোভিচকে সাথে নিয়ে বেশ খাটাখাটুনি করে আকাকি আকাকিয়েভিচ মার্কেট থেকে ওভারকোটের প্রয়োজনীয় অংশাদি কিনে নিল। পেত্রোভিচ মজুরি হিসেবে ১২ রুবল নিল। যা স্বাভাবিকভাবে কম। কিছুদিন পর পেত্রোভিচ একটা অসাধারণ ওভারকোট নিজ ঘাড়ে নিয়ে ঠিক আকাকি আকাকিয়েভিচ অফিসে যাওয়ার আগে তার দিকে স্বগর্ভে ছুড়ে মারলো।

    নতুন ওভারকোট শরীরে চাপিয়ে বেশ ভাবসাব নিয়ে আকাকি আকাকিয়েভিচ অফিসে গেল। অফিসে সমাদৃত তো হলোই তার সাথে এ উপলক্ষে অফিসে তার বন্ধু থেকে সমালোচক সবাই বায়না ধরলো চা-পানি পান করবে। কিন্তু এক ওভারকোটেই তার কাহিল অবস্থা। শেষমেশ একজন এগিয়ে আসলো আকাকি আকাকিয়েভিচকে উদ্ধারকল্পে।

    বেশ জমকালো আয়োজন। আকাকি আকাকিয়েভিচ পৌঁছে যাওয়ার আগে অফিসের সবাই হাজির। হালকা পান, হাসি-তামাশা ও গানের সমুদ্রে আকাকি আকাকিয়েভিচ ঠিক তাল মেলাতে পারে না। অনভস্ত্যতার কারণে তার ঠিক গুলিয়ে না আসলেও অস্বস্তি বোধ করে। আকাকি আকাকিয়েভিচ আগেভাগে চলে যেতে চাইলেও তার গতিপথ আটকে রাখে তার সহকর্মীরা।

    হালকা পানে আকাকি আকাকিয়েভিচ ঠিক পথ ঠাহর করতে পারে না। টলতে টলতে পথের অন্ধকার মাড়িয়ে গ্যালেও তার বাসার হদিস সে ঠিকঠাক খুঁজে বের করতে পারে না। এমন ঘোর লাগা বেগোর সময়ে ঠিক দুইজন তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। এক হ্যাচকা টান দিয়ে সদ্য আকাশের চন্দ্র ওভারকোট ছিনিয়ে নেয়। এক চোটে আকাকি আকাকিয়েভিচ বেঘোর হয়ে আবার ক্ষনিক পরে সম্বিত ফিরে পেলে দেখে অদূরে পুলিশ গল্প করে যাচ্ছে।

    তারপরের দিন আকাকি আকাকিয়েভিচ অফিসে যায় অচল ওভারকোটে ভর করে। সব জেনে সহকর্মীরা বলে পুলিশকে জানাতে। পুলিশের বড়কর্তার সাথে দেখা করেও ওভারকোটের হদিস পায় না। শেষতক এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তার কাছে ধরণা দিয়েও অপমানিত হয়ে বিষন্নতার মাথা খেয়ে আকাকি আকাকিয়েভিচ দিনাতিপাত করে।

    ওভারকোটের অমার্জনীয় ও গুরুশোকে আকাকি আকাকিয়েভিচ দুমড়েমুচড়ে গেলেও নশ্বর জীবনের ইতি টেনেছিল কিছুদিন পরই।

    কিছুদিন পর চাউর হয়ে গেছে গোরস্তানের আকাকি আকাকিয়েভিচ মোড়ের সেতুতে ও রাস্তার আশেপাশে সবার ওভারকোট খুলে নিচ্ছে। অবস্থা এমন বেগতিক হলো, তাকে অপমান করা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার ওভারকোট যখন খুলে নিতে চাইলো তখন।

    এভাবেই আকাকি আকাকিয়েভিচের স্বপ্নের ওভারকোটের সাথে সাথে সে নিজেই এই অমানবিক বিশ্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল। সরকারি কর্মকর্তার অতিভাব কিংবা পুলিশের অসহযোগিতা ও অফিসে নিত্যদিনের টানাহেঁচড়ার অবসান ঘটিয়ে আকাকি আকাকিয়েভিচ একটা রঙিন ওভারকোট গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে।

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img