মাসুদ পারভেজ:
যে গল্পের শেষ নেই ; যা ভাবতে গিয়েও হোঁচট খেয়েছি এবং যা মাথায় আসি আসি করেও আসে নি ।
সভ্যতার বাঁকে বাঁকে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানে চলার এই মহাজাগতিক অভিযাত্রায় কত কি যে ঘটে গেছে তা এক অপার বিস্ময়ের সমাধি সৌধ । এত এত প্রাণ ,অনাচারের কল ঘেঁষে আজকের যে সভ্যতা (!) তা ভেবে দেখলেই চলে যেতে হয় সুদূরে । বনে- বাদাড়ে , আমাজনের গহীন পেরিয়ে গ্রীক সাম্রাজ্যে কিংবা রোমের আগুনের উত্তপ্ত কুণ্ডলীতে । বাঘের খাঁচায় যে ছিন্নভিন্ন মানুষ বাঁচার জন্য নিজেকে সঁপে দিচ্ছে ক্ষুধার্ত বাঘের নখরে , তা দেখে স্পষ্টত সোৎসাহে শকুরের মত ঘোঁত ঘোঁত করা অমানুষের দল কিংবা হানাহানি ও বিভেদে নিজেদের ব্যতিব্যস্ত রাখার যে কলাকৌশল তা থেকে আজও রেহাই মেলে নি ।
সভ্যতার এই ক্রমবিকাশের পথ ধরে মানুষের সাথে সাথে প্রকৃতিও নানা রুপে বিরাজমান । এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য, বিবর্তন,প্রাণের উৎপত্তি ও মানুষের খাপ খাইয়ে নেওয়ার এ বিরাট ভোজসভায় নিয়ত পরিবর্তনের বহর সদা চালু আছে । এ রহস্যে ডুব দেওয়া গেলেও এর কূলকিনারা বের করাটা বেশ কঠিন ।ইউরেনিয়ামের বুক চিরে পৃথিবীর বয়স জানা গেলেও ক্রমবিকাশের সাথে সাথে নিরেট প্রয়োজন ছাপিয়ে সভ্যতার যে উত্তরণ ,তা খুব কুৎসিত । রক্তাক্ত । ও দ্বন্দমূলক । বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার আগে বাঁচার তাগিদে মানুষের জোট করা, জোট ভাঙ্গা ও নিজেদের মধ্যে হানাহানি ঢেকে এনে নিজেদের শেকলে বাঁধার যে বিরাটাকার আয়োজনের সূচনা করেছিল তা চলছে সগৌরবে । এ থেকে মুক্তি সুদূরে নিহিত ।
বলছিলাম মানুষের কথা কিন্তু প্রাণ ও প্রাণীর ; তারাই তো সভ্য আর অসভ্যের মাঝে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া নিয়ত অংশ । প্রথম শিরদাঁড়াওয়ালা প্রাণী মাছ না হয় কানকোর সাথে ফুসফুসের কাজ চালতে পারে কিন্তু তাদের ডাঙ্গায় তুললে যে তুলকালাম হয় তা তো মানুষের নিত্য সঙ্গী । যদিওবা বিবর্তনের সর্পিল পথে মানুষের আদি উৎস মাছ । যেমন বানর ,শিপাঞ্জী কিংবা ওরাংওটাং এর সাথেও মানুষের সম্যক সম্পর্ক আছে বলে জানাচ্ছে বিদগ্ধজন । তাহলে এই যে নিজেদের আরও ভালো অবস্থানে নেওয়ার পরম আখাঙ্কা তা থেকে গরিলা কিংবা উল্লেখিত প্রাণীরাও পিছিয়ে ছিল না । তাদের মধ্যে কিতপয় গাছের উঁচু মগডাল থেকে নেমে নিচে বিচরণ করার যে অনত্যাবশকীয় সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল তা থেকে আজকালকার মানুষ ও ব্যতিক্রম কোথায় !
জলে স্থলে ডাঙ্গায় যে প্রানগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের পেছনের ইতিহাস খুব নাড়া দিয়ে যাবে, অনুধাবন যারা করবে । কিংবা বিবর্তনের পথ বেয়ে ডারউইন যে প্রাগৈতিহাসিক পরিবর্তন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে তার সাথে আদি মানুষের বনে জঙ্গলে এঁকে রাখা অবাক ইন্দ্রজালের ঘোর কিভাবে কাটানো যায় ? এ যে অভিযাত্রা , দারুণ এক ইয়েদিপাস থেকে আজকের ঘোড়ার চোখের নিমিষে পলক ফেলার আগে দারুণ গতি । যা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছে আর আমরা নিমিষেই ভুলে যাচ্ছি আমাদের অন্ধকারের সামন্তদের ।
মানুষের এই দূরগতিতে মানুষের কলজে চিরে রক্তিম রক্ত হাতে নিয়ে নীল সভ্যতা গড়ার কারিগর ও মানুষ । গতর খাটিয়ে নিজের সাম্রাজ্য হুরহুর করে বাড়িয়ে নিয়ে সভ্যতাকে চাকচিক্য করে তোলার কারিগরও মানুষ । অবশ্য ততদিনে মানুষ তার আদি উৎসদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে আনায়াসে । যা থেকে তারা এসেছে কিংবা যাদের জিন তারা বহন করে যাচ্ছে তাদের চোখের পলকে শুয়ে দেওয়ার নানান কায়দাকানুন তারা বেশ গোছানোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এর মধ্যে মানুষের ঘামে গড়ে ওঠা সভ্যতায় মানুষ নিষ্পেষিত।সেখানে প্রায়ইজন স্রেফ গতর খাটানো জানোয়ার । যাদের মাগনা শ্রমে ফুলেফেঁপে বেড়ে ওঠা বণিকরূপী দেশ বিদেশ ছাপিয়ে আমাদের মতন উর্বর দেশেও এসেছিল ব্যাবসার নামে শোষণে ব্যতিব্যস্ত থাকতে । এর মাঝে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে ।প্রাণ দিয়েছে কিন্তু নানা কালো অধ্যায় পেরিয়ে মানুষ জিতে গেছে ; জেতাটা নেহাত প্রয়োজনের নিমিত্তে ধরা হলে ।
প্রাণের এই গল্পের নিম ইতিহাস মানুষকে দাঁড় করিয়েছে এক মোহনায় । যেখান থেকে পেছনে ফিরে থাকালে উজ্জ্বল আলোর নিচে দৃষ্টিগোচর হয় বর্ণিল অন্ধকারের । দাস প্রথা বেয়ে সভ্যতার এই নিদারুণ ও অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় অগ্রযাত্রায় মানুষ ঠকেছে । প্রাণ সঙহার হয়েছে । প্রাণ নিস্তেজ হয়েছে । ফলতঃ দিনশেষে বিজ্ঞানের ডামাডোলের নানান বাতাবরণে পৃথিবী এগোচ্ছে ; চোখের নোনা জলে মানুষকে ভাসিয়ে নিতে । না, তাও হয়তোবা বলা না গেলেও আদি মানুষের উৎসরাও তো বেশ ভালোই ছিল । সবাই শ্রম দিয়ে সবার আহার জোগাড় করতো । কিন্তু যখন তারা ছিন্ন হলো, তখন বিভেদ এল । বিভেদ রুখতে কানুন আসলো । কানুন এক সময়ে কালাকানুনে পরিণত হল । অতঃপর চূড়ান্ত বিভক্তির সূচনা তারা করে গেল । এই কালাকানুনে যুক্ত করলো ধর্মের আদেশ নিষেধ । এক দল তা পালন করাতে নিজেদের নিয়োজিত করলো । তাদের পেট ফুলেফেঁপে উঠেছিল দাসদের ঘামে । তাদের উপর আসলো রাজা, সামন্ত কিংবা মহারাজারা । এর ফলে মানুষ আরও সস্তা হয়ে গেল । আকাশে ভোঁ ভোঁ করে দৌড়ে বেড়ানো শুন্যে ভাসা বিমান কিংবা চরকার টান থেকে বেরিয়ে আসা সুতোর চোখ ধাঁধানো নানা মেশিনে মানুষ আরও স্বকীয়তা হারালো । ফলে সভ্যতা এগিয়ে গেল ; মানুষ মারার যন্ত্র আবিষ্কার করে মানুষ নিজেদের শক্তিশালী বলে ঘোষণা দিল ।
শিল্প বিপ্লব, রেনেসাঁস কিংবা বিজ্ঞানের অদম্য জয় যাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা একদিন আবিষ্কার করে ফেলবো ; কিভাবে লোভ মানুষকে ধ্বংস করেছে । কিভাবে প্রাণী তার প্রাণ হারিয়েছে ।
বনের জানোয়ার থেকে মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার যে যাত্রা আমরা জানছি তার ভেতরের কলকব্জা কোথায় নিহিত আছে। তার অন্তর্নিহিত শক্তি কোথায় আমাদের করাঘাত করছে, আদৌ করছে কি না ।
মানুষ যেহেতু জয় করেছে , হোক সেটা ক্ষয় করে ; তবুও মানুষের মুক্তি মানুষের হাতেই নিহিত আছে । যা সময় তার হাতে ম্যান্ডেট তুলে দিয়েছে…