More

    পাঠ প্রতিক্রিয়া: মাদাম বোভারি

    মাসুদ পারভেজ:

    বাস্তবতার নানা ফারাক ও সামাজিক নানা অসঙ্গতির মধ্যে মানুষের হাঁসফাঁসের প্রাগৈতিহাসিক বর্ননার সাথে সাথে চাওয়া-পাওয়ার নিদারুণ যাতনার এক সরস আখ্যান মাদাম বোভারি ।

    যেখানে এম্মা আর চার্লসের সংসারে একে একে উপস্থিত হয় রুডলফ, লিয়, লেহুড়ে, হোমা । ডাক্তার চার্লসের দ্বিতীয় বিয়ে সুন্দরী ও গুণবতী এবং অতি অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এম্মার সাথে সম্পন্ন হয় । চার্লস সেখানে দারুণ খুশি ও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে, কিন্তু ধীরে ধীরে এম্মার আগ্রহে ভাটা পড়তে থাকে ।

    কারণ বিভিন্ন বইয়ে কিংবা আশপাশের দারুণ পরিবেশে এম্মা যে স্বাপ্নিক ও সাহিত্যমনা পুরুষকে কামনা করতো চার্লস ঠিক সে অর্থে তার নায়ক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারছে না । যদিওবা চার্লস ভাবে সে এম্মাকে সুখী করতে পারছে । আর এম্মাও তাকে পেয়ে খুশি ।

    এম্মার চার্লসের সাথে অস্বাভাবিক পরিবেশে দিন পার করার মাঝে আগমন ঘটে অবস্থাসম্পন্ন খামারি রুডলফের । যা এম্মাকে একটা ঘোড়া উপহার দিয়ে তাদের আগামি প্রণয়ের সূত্রপাত করতে সমর্থ হয়েছে । আর রুডলফকেও প্রথম দেখাতে এম্মা দারুণ পছন্দ করে ফেলে । ফলত তাদের মধ্যে গড়ে উঠে সমুদ্রের বিশালাকার জলরাশির মতন গোপন অভিসার । যা তাদের উম্মাদনায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বহু সময় । তার সাথে ঘোড়ার চড়ার পর মিলিত হওয়া, রাতে এম্মার বাসা লাগোয়া বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো কিংবা এম্মার স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে রুডলফকে মনের গহিনে স্থান দেওয়া ; সবমিলিয়ে তারা একদিন ঠিক করলো চার্লসের নিরাসক্ত সংসার থেকে তারা পালাবে। এর আগে এম্মা চার্লসের সাথে দারুণ অসহযোগিতা করে নিজেকে একা করে ফেলেছিল । কিন্তু চার্লস ভেবে নিয়েছিল এ এম্মার স্নায়ুতান্ত্রিক বৈকল্য । যা সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু এম্মা এমনকি নিজ মেয়ে বার্থের ভবিষ্যতের চিন্তাও মাথা থেকে দূরীভূত করে অবশেষে দিনক্ষণ ধরে নিয়ে লেহুড়ের দ্বারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসলো ।

    এদিকে রুডলফ দারুণ ভোগকারী । এর আগেও বহু মেয়ের সাথে তার গভীর প্রণয় ছিল । সে গোপন অভিসারের এক নিদারুণ প্রতিভূ হিসেবে দিনে দিনে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল । তার কাছে স্থায়ী কোন সম্পর্কের স্থান নেই । যা সাময়িক তাই তার কাছে সোনা রুপোর চেয়ে দামি । এবং এম্মাও তার কাছে তাই ছিল । এদিকে এম্মা নিজেকে আবারও সুখী ভাবতে ভাবতে দিন বদলের প্রহর গুণে যেতে লাগলো । সে ভাবছে তার মুক্তি এসে গেছে । তার সময় এখন প্রজাপতির ডানায় ডানায় বিশ্ব দেখার । সময় এখন কবিতায়, সাহিত্যে কিংবা উপন্যাসের পাতায় নিজেকে দেখার । কল্পনার সবটুকু রঙ মাখা শেষ হলে যাওয়ার প্রাক্কালে রুডলফ জানালো সে এম্মার সাথে পালাচ্ছে না । সে তার চাকর দ্বারা ফল ও ফুলের তোড়া পাঠিয়ে অজুহাত দেখাল ; এম্মার চার্লসের সাথে থেকে নিজেকে এই পৃথিবীর বাইরের সাথে সংযোগ স্থাপনের দারুণ চেষ্টায় আবারও পিছিয়ে পড়লো ।

    রুডলফের সাথে তার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে এম্মা আরও ভেঙ্গে পড়লো । সে তার এই চলমান অসঙ্গতিতে দারুণ একা হয়ে গেল । যদিওবা চার্লস এসব জানতে পারে না । সে আগের মতই তার প্রিয়তমাকে সমান উচ্ছাসে ভালোবাসে । তাকে নিয় সে স্বপ্ন দেখে । এবং নানা উপায়ে সে এম্মাকে খুশি রাখতে কসুর করে না । কিন্তু এম্মার বুকজুড়ে এই নিরস জীবন থেকে পালানোর  মধ্যেই তার স্বার্থকতার আগামী বুনে যায় । সেখানে চার্লস ঢাল তলোয়ার বিহীন এক নায়ক । যে ডাক্তারি পেশায় নিজেকে ধীরে ধীরে সম্মানের আসনে নিয়ে গিয়ে একটা বলবান জীবনের খড়কুটো জুগিয়ে চলছে ।

    এম্মা ছোটবেলায় নাচ-গান শিখতো । এমনকি কিছুদিন পিয়ানো ও । এই ব্যর্থ সময়ের নিদারুণ পদাবলীতে সে আবারও পিয়ানো শিখতে চায় । যা চার্লস দ্রুত অনুমোদন দেয় । রুয়েন শহরে এম্মার পাণিপ্রার্থী লিয়ের সাথে তার দেখা হয়ে যায় । লিয় এম্মার ভীষণ অনুরাগী ছিল । কিছুদূর আগানো স্বত্তেও লিয় এম্মার কাছে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে রুয়েন শহরে চলে যায় । অবশেষে চার্লস ও এম্মার সাথে তাদের দেখা হয়ে যাওয়ার মাঝে আবারও এম্মা পেছনের সোনালি সময়ে ফিরে যায় । আবার এম্মা ভাবতে থাকে লিয় তার স্বপ্নের পুরুষ । পিয়ানো শেখার নামে এম্মা ও লিয় পৌঁছে যায় গোপন অভিসারের স্বপ্নশিখরে । তাদের কাম, কামে ভেজা ঘাম মিলে তৈরি করে অদ্ভুদ এক ঘোর । যার গন্ধে মাতাল তরণীতে এম্মা লিয় একে অন্যের হয়ে যায় । মিশে যায় স্বত্তার সবটুকুতে । এভাবে চলতে চলতে লিয় এক সময়ে তার চারিপাশ থেকে বাঁধার দ্বন্দে পড়ে । তার অফিসের বস, তার পরিবার থেকে এম্মাকে ব্যাভিচারিণী আখ্যা দিয়ে তার সাথে না মিশতে বলা হয় ।

    এম্মার সৌখিনতায় লেহুড়ের কাছে জমা হয়ে যায় হাজার হাজার ফ্রা । এদিকে চার্লসের ডাক্তারি পেশার জোয়ার নিম্নমুখী । এম্মার এই দারুণ উর্ধ্বমুখী জীবনে চার্লস হিমশিম খেলেও তারা এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিনতির দিকে । দেনা শোধে এম্মা চার্লসের অজান্তে খামারের একাংশ বিক্রি করে ফেলে আর নিয়মিত বিরতিতে সে ঋনপত্রে স্বাক্ষর করতে থাকে ।  চার্লসের মায়ের কাছেও কয়েকবার হাত পাতা হয়েছে । সেখানেও তারা আর তেমন কিছুর আশা করছে না । আবার একজনের পা ঠিক করতে গিয়ে চার্লসের ভুল চিকিৎসার দরুণ চার্লসের রোগীও তেমন নেই । সবমিলিয়ে লেহুড়ের কাছে এম্মা আর চার্লস বন্দী ।

    লেহুড়ের ভীষণ চাপাচাপিতে এম্মার মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাচ্ছে দিন দিন । এদিকে চার্লস নিজেও লেহুড়ের কাছে বন্দী । ফ্রা জোগাড় করার জন্য এম্মার শত চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে । রুডলফ, লিয় এমনকি আরেক অবস্থাসম্পন্ন খামারি এম্মার চরিত্র নিয়ে ঠাট্টা করতে লাগলো, যখন এম্মা তার কাছে ফ্রার জন্য গিয়েছিল । তার বিকিয়ে দেওয়া সতীর্থে ভাগ বসাতে চাইলেও এম্মা ভীষণ রাগে সেখান থেকে চলে এসেছিল ।

    চারিদিকে অন্ধকারে পতিত হয়ে এম্মা জীবনের সাতপ্যাঁচ ভাবতে লাগলো । তখন তার মনে পড়ে এ জীবনের লাগামের কথা । লাগাম ছেড়ে তার চলা উদোম জীবনের কথা । যে জীবনের সন্ধান এম্মা করছিল সে জীবন থেকে এম্মা বহুদূরে । সবাই তার যৌবন ব্যবহার করেছিল । সেই গোপন অভিসারে সে ভীষণ তৃপ্ত হলেও আদতে তারা কেউই তাকে সে অর্থে ভালোবাসে নি । অথচ এম্মা ভালোবাসার কাঙ্গাল । এমন ডানা ভাঙ্গা জীবনের পিছে সে দৌড়াতে চেয়ে চলমান জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, যা থেকে তার নিস্তার মিলছে না । উল্টো চক্রাকারে সে আটকে গেছে ।

    লেহুড়ের বেঁধে দেওয়া সময় অতিক্রম করে যাবে ,অথচ এক ফ্রাও ম্যানেজ করতে পারে নি এম্মা । তার চোখেমুখে ভাসছে অপমান হওয়ার দৃশ্য, চার্লস ও তার এতদিনের মান সম্মান খোয়া যাওয়ার নিরস যন্ত্রনার দৃশ্য । তার কেবলি মনে আসে এর জন্য আদতে সে নিজেই দায়ী । অথচ চার্লস তাকে নিয়ে সুখী হতে চেয়েছে সবসময় । কিন্তু তার সুখের পেছনে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ানোর মাঝেই তাদের সর্বনাশ ঘটতে চলছে ।   

    এ ব্যর্থ পদাবলীর ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ তরী থেকে বাঁচতে জাস্টিনের সহায়তায় সে নিজেকে আত্নঘাতী করে ফেললো । ঘরে ফিরে সে ভীষণ একাকী হয়ে শেষ সময়টুকু কাটাতে চাইলো । চার্লস ব্যতিব্যস্ত হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছে আর ভাবছে কি তার অপরাধ । সে অনেক ভেবেও অপরাধ খুঁজে পায় না । এম্মা তাকে একটা চিরকুটের কথা জানায় । যাতে কাউকে দায়ী না করার কথা উল্লেখ আছে । এম্মার অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে চার্লস নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবে কিন্তু ততক্ষণে ঢের দেরি হয়ে যায় । হোমা ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেও কোন লাভ তাতে আসে না । চার্চের যাজকের পবিত্র পানিতে এম্মার সাময়িক ক্রিয়া হলেও আদতে তা ছিল সাময়িক প্রলেপ মাত্র । বার্থেকে শেষবার চুমু দিয়ে এম্মার চেহারা বিষাক্ত থেকে বিষাক্ততর হলে সে চিরবিদায় নেয় নীল চার্লস, রুডলফ, লিয় এবং অতি অবশ্যই লেহুড়ের কাছ থেকে ।

    এম্মার আরাধ্য জীবনের অনাসক্তি হিসেবে চার্লস ভীষণ একা হয়ে গেল । হোমা এখন অত্র এলাকার নেতৃস্থানীয় । বার্থের ঠিকানা দাদী, দূর সম্পর্কের ফুফু হয়ে সে এখন কারখানার শ্রম দেয় । আর এম্মা চলে যায় টানেলের শেষ প্রান্তে । যেখানে আলো নিভে গেছে ; ভীষণ যন্ত্রণায় ।

    © এই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
    / month
    placeholder text

    সর্বশেষ

    রাজনীাত

    বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য বিদেশে হাসপাতাল খোজা হচ্ছে

    প্রভাতী সংবাদ ডেস্ক: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা মনে করেন আবেদনে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক...

    আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

    আরো পড়ুন

    Leave a reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    spot_imgspot_img