মাসুদ পারভেজ:
আত্নহত্যা প্রবণ জাপানের টিনেজারদের নিয়ে লিখিত হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ সারাবিশ্বের তরুণদের জন্য একটা অনন্য সংকলন । বিশেষ করে টিনেজারদের উত্তান-পতনের সবিশেষ আয়োজনের এত খুঁটিনাটি উল্লেখ করা বিরল বটে । আর তা বিশেষ অলঙ্কৃত হওয়ার কারণ বর্তমানের জনপ্রিয় ও শক্তিশালী লেখক হারুকি মুরাকামি ।
নাওকো-কিজুকি,নাওকো-ওয়াতানাবে,রেইকো-নাওকো,রেইকো-ওয়াতানাবে,ওয়াতানাবে-রেইকো অথবা ওয়াতানাবে- মিদোরি এতসব দৃশ্যপটের সুবিন্যস্ত ঢালি নিয়ে মুরাকামি টিনেজারদের মনোজগতের সবটুকু রস নিংড়ে নিয়ে সবিস্তারে লিপি করেছেন । যেখানে মানব মনের অনন্য এক খেলের খেলোয়াড় নাওকো-ওয়াতানাবেরা । সেখানে প্রাকৃতিক বিষয়াদি গভীরে পোতা আছে । আর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় একটা বিশেষ বয়সের রহস্যকূপ । আর তার গভীরতা এত গভীরে নিহিত আছে যেখানে ধপাধপ পতিত হয়ে একে একে হারিয়ে গেছে জীবনের সোনালি অধ্যায় থেকে কিজুকি, নাওকো কিংবা তারও আগের নাওকোর বোন, চাচা কিংবা আরও আগের অগণিত প্রাণ, যারা ফসিল হয়ে বর্তমানকেও সমানভাবে টেনে যাচ্ছে ; আর এই যাত্রায় নিত্য নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো কুড়ি ।
কিজুকি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র । যে জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছিল । তার মিষ্টি বান্ধবী নাওকোর সাথে তার দারুণ অন্ত্যমিল । সেখানে ওয়াতানাবে এক বোকাসোকা তরুণ । যার কাছে হোস্টেলের জীবন, পড়ালেখার সাথে সাথে নাওকো-কিজুকিকে সঙ্গ দেওয়াটাই কাজ । কিজুকির সাথে নাওকো কেমন একটা ভাবলেশহীন চরিত্র । ঠিক কিজুকির বিপরীত । কিজুকি যেখানে প্রায় রাতে নতুন মেয়ে নিয়ে বিছানায় যায়, নাওকো সেখানে মুখে কুলুপ এঁটে চলা একজন । যে আবার কিজুকির সবটুকু জেনেও নিদারুণ নীরব আর নির্লিপ্ত । নাওকোর মনোজগৎ জুড়ে অতি কাল্পনিক সব ভর করে থাকে ; কে জানে, হয়তোবা তার বোন, চাচা অথবা দেশের হাজারো তরুণ–প্রবীণ, যারা সহসাই মরে যাবে বলে নিজের পথের রেখা এঁকে চলে নিত্য । কিজুকি সেক্সপ্রবণ কিংবা কামনাপ্রিয় হলেও তার বান্ধবী নাওকোর সাথে তার সহবাস হয় নি । নাওকো যেটা উল্লেখ করেছে ওয়াতানাবের সাথে তার কেমন জানি উত্তেজনা আসে না । অথবা তার ঠিক অনুভূতি ভোতা হয়ে যায় যখন কিজুকির সাথে তার অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহুর্ত আসে । এসব নিয়ে তারা অবশ্য উচ্চবাক্য করে নি । কারণ নাওকো সেটা মেনে নিয়েছে আর কিজুকি তা চড়া মূল্যে উসুল করে নিত্যনতুন মেয়েগুলোর সাথে বিছানায় মিলিত হয়ে; সেখানেই তার স্বর্গসুখ । আর নাওকো সব জেনেশুনে দেখে যাওয়ার ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে । এসবের মাঝে ওয়াতানাবে এক দারুণ সংযোজোন ।
ওয়াতানাবের সাথে কিজুকির অন্তরঙ্গ হওয়ার দিনগুলোতে আচমকা এসে উপস্থিত হয় মিদোরি। যে একেবারেই স্বাধীনচেতা। মা হারা তারা দুই বোন , তারমধ্যে একজন আবার নিজের মত করে থাকার স্বাধীনতা চেয়ে তার ছেলেবন্ধুর সাথে থাকছে । তার বাবা আবার সব ছেড়ে উরুগুয়ে যাবার মনঃস্থির করেছেন। অবশ্য তা আর হয়ে উঠে না। কিছুদিন হাসপাতালে থেকে তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। এসবে মিদোরিরি খুন একটা ভবিতব্য হয় না। বরং সে নিজেকে আরও স্বাধীন ভেবে তার বাবার বুকস্টোর বিক্রি করে দিচ্ছে । নিজের মত করে থাকার জন্য মিদোরি তার সাথে পেন্ডুলামের মত ঝুলতে থাকার ছেলেবন্ধুকে বিদায় বলে দেওয়ার উপলক্ষ খুঁজে । হয়তোবা ওয়াতানাবের কাছ থেকে আগ্রহ পেলে । হয়তোবা একদিন ওয়াতানাবের কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবে বলে…
ওয়াতানাবে নাওকোর জন্য অপেক্ষা করছে, বিশেষ আগ্রহভরে এই অপেক্ষার জন্য ওয়াতানাবের কোন আফসোস নেই । বরং সে এখন আর মেয়ের সাথে বিছানায় যায় না। রাত-বিরাতে হোটেলে কাটায় না। নাওকোর সাথে দেখা করে আসার পর থেকে সে এক মনোঃকষ্টে ভোগে । এক দিকে নাওকোর জন্য তার অপেক্ষা আবার অবচেতনে মিদোরির জন্য অপ্রকাশিত ভালোবাসা। এর মাঝে নাওকোর রুমমেট রেইকোর কাছে থেকে পাওয়া চিঠি ওয়াতানাবেকে আরও ভাবনায় ফেলে দেয় । নাওকো স্বাভাবিক না । সে আবার স্বাভাবিক জীবনে নাও ফিরতে পারে । এক ভীষণ অস্বাভাবিকতা নিয়ে সে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে । মেডিসিন ও ডাক্তারের প্রথাওয়ালা চিকিৎসার বাইরে নাওকোর ভালো হয়ে উঠাটা খুব একটা তাড়াতাড়ি হচ্ছে না, সবার সহযোগিতা স্বত্তেও। যা নাওকো, রেইকো দুইজনই জানে, গভীরভাবে বোঝে। কিন্তু তারা যা করছে তা কেবল মাত্র চেষ্টা করে যাওয়া, ভিন্ন এবং প্রাকৃতিক উপায়ে ।
ওয়াতানাবে যখন নাওকোকে দেখতে গেল তখন সে একেবারে স্বাভাবিক ছিল। তাদের কথা, আলাপ কিংবা অন্তরঙ্গ সবকিছুই ভালো ছিল । যদিওবা তাদের মধ্যে সেক্স হয় নি, যেটা তারা ভিন্নভাবে উপভোগ করে থাকে। কারণ নাওকো এখনও ঠিক প্রস্তুত না, প্রথমবার তারা সেক্স করার পরে ঠিক যেমন তাদের মধ্যে আর বিছানা শেয়ার করা হয় নি। এসব ওয়াতানাবে মেনে নিয়েছিল। কারণ তার মনপ্রাণ নাওকো চাইতো । এদিকে দিন গেলেও নাওকো সুস্থ হয়ে উঠছে না । নাওকোর পরিবার কিংবা বিশেষায়িত প্রাকৃতিক চিকিৎসালয় উভয়ই নাওকোকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলো । কিন্তু প্রাকৃতিক হাসপাতাল থেকে একবার যারা চলে যায় তাদের আর ফেরার উপায় থাকে না ।
মিদোরির ব্যাপারটা অনেকটা নিজের অধিকারবলে ওয়াতানাবের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মতন । তাদের ঘুরাফেরা, খাওয়া, অন্তরঙ্গ হওয়া (সেক্স ব্যতীত), একে অন্যের কাছে জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ জানানো, একসাথে থাকা সব মিলিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বুনন তাদের উভয়ের মাঝে বিরাজমান । অন্য দিকে মিদোরির সাথে তার ছেলেবন্ধুর ঠিক মিল না হওয়া , যেটা তার বাবা মারা যাওয়ার পরেও ছেলেবন্ধুর সাথে ঘুরতে যাওয়ার পরেও ঠিক মিল হয় নি বরং তাদের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ ও বোঝাপড়া স্পষ্টতর হয়ে যাওয়া ; অতঃপর মিদোরির একা হয়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে যায় ।
প্রাকৃতিক চিকিৎসালয় থেকে নাওকোর চলে আসার আগে রেইকোর সাথে দেখা করার রাতে নাওকো এই ঝঞ্জাবিভ্রাট পৃথিবী থেকে নিজের দাবির রফাদফা করে ফেলে। রাতের অন্ধকারে নাওকো আলো ফেলে অন্ধকার দূরীভূত করে পরপারে চলে গিয়েছিল। যা ওয়াতানাবেকে ভীষণ দুর্বিপাকে ফেলে দেয় । যার শোকে ওয়াতানাবে গৃহত্যাগী ছিল মাসাধিক। একটা পর্যায়ে তাদের সম্পর্ক চিঠিপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ওয়াতানাবের হৃদয়ে নাওকো সবসময় ছিল । যে সম্পর্ককে ওয়াতানাবে খুব যত্নের সাথে লালন পালন করতো । যার ভালোবাসায় ওয়াতানাবে অন্যমেয়ের সাথে বিছানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, যাকে চিঠি লিখেই স্বর্গসুখের উপলক্ষ খুঁজে বেড়াতো সেই নাওকোর বিদায়ে সে ছন্নছাড়া হয়ে গেল ।
অবশেষে ওয়াতানাবের সম্বিত ফিরলে সে আবার মিদোরিকে নিয়ে চিন্তা করে। মিদোরি তার জন্য আক্ষরিক অর্থেই অপেক্ষা করছিল। এর মাঝে রেইকো প্রাকৃতিক হাসপাতাল ছেড়ে ওয়াতানাবের সাথে দেখা করতে আসলো। তাদের বোঝাপড়া যেন নাওকোর প্রক্সি । নাওকোর জামাকাপড় পড়ে রেইকো আসলো। ঠিক যেমনটা নাওকোর একমাত্র চিরকুটে লেখা ছিল। নাওকোর শরীর আর রেইকোর শরীরের নানার স্পর্শকাতর অঙ্গের মাঝে অনেকটাই মিল ছিল। যা নাওকো ও রেইকো নিজেরাই আবিষ্কার করেছিল । রেইকো তার বন্ধুর আবাহনে সঙ্গীত ইশকুলে চলে যাওয়ার আগের রাতে ওয়াতানাবেকে ভীষণ কামুক করে তুললো । ওয়াতানাবে আর রেইকোর সেই উন্মাতাল স্বর্গসুখে নাওকোর আস্থা ছিল, হয়তোবা সে কারণেই তারা চারবার নিজেদের শরীরের উত্তাপ ভাগ করে নিয়েছিল । রাতভোর তাদের মাতাল কামনায় ওয়াতানাবে আর রেইকো পরস্পরের কাছে রীতিমত চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল নিজেদের সুখী করার ।
মিদোরির সাথে দেখা করে ওয়াতানাবে তাদের আগামীর রুপরেখা ঠিক করে নিয়েছে নিশ্চয় । যা তাদের পরম আখাঙ্কার ছিল । নাওকো-কিজুকির এই নিদারুণ প্রস্থানে স্থান দখল করে নিয়েছে ওয়াতানাবে–মিদোরি । যা এক ভয়ানক অবস্থার মানসপট বলে দেয় ; টিনেজারদের মনের সঙ্গিন অবস্থার এই নিদারুণ উত্তরণে আমরা সবাই তুলোর মতোন উড়ে বেড়াচ্ছি । কোন এক সময় বেয়ারা মুহুর্ত এসে বলবে, চলো ।